২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ওই ঘটনায় তদন্ত হলেও দীর্ঘ ১৫ বছরেও উন্মোচিত হয়নি ‘আসল রহস্য’। ফলে ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তও দাবি করেছেন নিহতদের স্বজনরা।
ওই ঘটনার ১৫ বছর পর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এসেছে বিদ্রোহ শুরুর পর নেয়া তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ। ব্রিগেড কমান্ডারের নেতৃত্বে ১০ জন অফিসারের নেতৃত্বে ৬৫৫ জন অফিসার সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’।
তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’ ও বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এ নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন তিনি। যেখানে উঠে এসেছে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপের বিষয়ও।
মইন ইউ আহমেদ জানান, প্রতিদিনের মতো ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টায় সেনাসদরে কাজ শুরু হয়। ওইদিন সকালে সেনাবাহিনীর পরবর্তী বছরের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। সকালে সেই বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মইন ইউ আহমেদ। ওই সময় সিজিএস লেফটনেন্ট জেলারেল সিনহা তাকে এসে বলেন, আমাদের কাছে কিছু মর্টার আছে, যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে। এগুলো তারা নিয়ে গেলে আমাদের উপকার হবে।
পরে বিষয়টি নিয়ে বিডিআরের ডিজি জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। ওই সময় বিডিআরের ডিজি মর্টারগুলো নিতে রাজি হন। তখন পর্যন্ত বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে কেউ জানতেন না।
পরবর্তীতে মইন ইউ আহমেদ ও সিজিএস লেফটনেন্ট জেলারেল সিনহা ওই বৈঠকে যোগ দেন। সেদিন সকাল ৯টায় শুরু হওয়া ওই বৈঠকে সবাই ব্যস্ত ছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে মইন ইউ আহমেদের প্রিন্সিপল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করে তাকে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন।
এ ঘটনা জানার পর কিছুক্ষণের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টার করলে তাকে ফোনে ব্যস্ত পান মইন ইউ আহমেদ। এরমধ্যে সামরিক গোয়েন্দারা তৎকালীন এই সেনাপ্রধানকে বিডিআর বিদ্রোহের পরিস্থিতি জানালে তিনি ভয়াবহতার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়াই তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ হিসেবে একটি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। যার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’। পরে এ বিষয়ে পিএসও এফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করা হয়।
এদিকে, সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিডিআরের ডিজিকে ফোনে পান মইন ইউ আহমেদ। ওই সময় তাকে বিডিআরের ডিজি জানান, দরবার চলাকালে দুইজন সশস্ত্র সৈনিক প্রবেশ করে একজন তার পেছনে দাঁড়ায়। এরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দরবার হলের ভেতরে থাকা সৈনিকরা বাইরে বেরিয়ে যায়। ওই সময় ঘটনাগুলো পরিকল্পিত ও পরিকল্পনামাফিক চলছে বলেও নিজের ধারণার কথা মইন ইউ আহমেদকে জানান বিডিআরের ডিজি। একই সময় বিডিআরের ডিজি তাদের ফেরত আনার জন্য সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটিলিয়ান কমান্ডারদের পাঠানোর কথা জানান। পরে মইন ইউ আহমেদ তাকে অপারেশনের কথা জানান।
অন্যদিকে সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। তবে এরমধ্যেই বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন শেখ হাসিনা। ফোনালাপে মইন ইউ আহমেদ তাকে অপারেশনের কথা জানালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, এই ব্রিগেডকে তৈরি করতে কতক্ষণ সময় লাগবে? পরে সময় জানিয়ে ব্রিগেডকে পিলাখানায় পাঠানোর অনুমতি চাইলে শেখ হাসিনা অনুমতি দেন। এরপর ব্রিগেড কমান্ডারের নেতৃত্বে ১০ জন অফিসার এবং ৬৫৫ জন অফিসার নিয়ে ৪৬ ব্রিগেড ১ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে।
তবে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে রকেট লাঞ্চার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে। পরবর্তীতে বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। এতে ঘটনাস্থলেই চালমের মৃত্যু হয়। লেফটন্যনাট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সেদিন তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের টিম পিলখানায় পৌঁছায় ১১টার পর। যদিও ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে সকাল ১০টার আগেই পিলখানায় পৌঁছান। ওই সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইওলে পাননি। সে সময় তিনি অনুমতি পেলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধা যেমন হতো, তেমনি ক্ষয়ক্ষতিও এমন হতো না বলে মনে করেন মইন ইউ আহমেদ।
তৎকালীন এই সেনাপ্রধান জানান, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পিএসও এএফডি তাকে জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। পরবর্তীতে দুপুর ১২টায় ফোন করে পিএসও এএফডি তাকে জরুরিভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে বলেন। একপর্যায়ে দুপুর ১টার দিকে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।
পরের ঘটনা জানিয়ে মইন ইউ আহমেদ বলেন, আমি যমুনায় যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান সেখানে আসেন। তাদের আমার পরে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। অনেকক্ষণ পর তারা সেখানে আসলে আমাদের জানানো হয়, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে যমুনাতে আসছে এবং তারা সাধারণ ক্ষমা চায়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাদের বলি। তখন আমি তাকে বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনো দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেয়ার প্রশ্নই নেই।
পরবর্তীকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে বসেন। ওই সময় নানক, মির্জা আজম ও তাপস ছিলেন। তবে আলোচনায় কী হয়েছে তা জানেন না বলে দাবি করেছেন মইন ইউ আহমেদ। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেন। এরপর তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।