গুপ্তহত্যার চেষ্টা, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে যাওয়া, নামীদামী তারকাদের সমর্থন আর ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি—যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এমন রোলারকোস্টার রাইড চলছে। এসবের অবসান ঘটতে যাচ্ছে আগামীকাল—৫ নভেম্বর— রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্র্যাট দলীয় কমালা হ্যারিসের মধ্যে থেকে একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কিন নাগরিকদের বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।
তবে এবারের নির্বাচনে প্রত্যেকের মনে বড় প্রশ্ন জাগছে; যুক্তরাষ্ট্র কি প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে ফের ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? আর এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে ৫ নভেম্বরের ভোটের পর। তবে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলীয় দুই প্রার্থীর মাঝে ব্যাপক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানের চালানো জনমত জরিপে।
জনমত জরিপ কী বলছে? প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে কে এগিয়ে? জনসমর্থন কার বেশি? ট্রাম্প কি বিজয়ীর বেশে আবারও হাজির হবেন নাকি কমালা হ্যারিস প্রমাণ করবেন যে, যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত একজন নারী প্রেসিডেন্টকে বরণের জন্য প্রস্তুত? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন চোখ রাখা যাক সর্বশেষ কিছু হিসেব-নিকেশে…
অ্যাটলাস ইনটেলের জনমত জরিপের ফল যদি বিশ্বাস করা হয়, তাহলে ৫ নভেম্বরের ভোটের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পই বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। ব্রাজিল-ভিত্তিক এই জরিপ সংস্থার সোমবার প্রকাশিত এক জরিপের ফলে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল নির্ধারণী সাতটি সুইং রাজ্যের সবকটিতে কমালা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তাদের ব্যবধান একেবারে সামান্য।
জরিপের ফলে দেখা যায়, সুইং রাজ্য অ্যারিজোনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং হ্যারিসের প্রতি ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। নেভাদায় জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৬ শতাংশ হ্যারিসকে সমর্থন জানিয়েছেন। এছাড়া নর্থ ক্যারোলিনায় ট্রাম্প ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কমালা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ জনসমর্থন।
অ্যাটলাস ইনটেলের জনমত জরিপ অনুযায়ী, জর্জিয়া রাজ্যেও এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই রাজ্যে ৫০ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান বলে জানিয়েছেন। মিশিগানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হ্যারিসের প্রতি ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। আর পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও কমালা হ্যারিস ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং উইসকনসিনে ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হ্যারিস ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন।
দেশটির সাত রাজ্যে অ্যাটলাসের পরিচালিত এই জনমত জরিপে গড়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে তিনি কমালা হ্যারিসের ৪৭ দশমিক ২ শতাংশের তুলনায় ৪৯ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন।
এখানে চমকে যাওয়ার মতো আরেকটি তথ্য দিয়েছে ব্রাজিলের এই জনমত জরিপ সংস্থা। অ্যাটলাস ইনটেল বলেছে, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও সবচেয়ে নির্ভুল জনমত জরিপ প্রকাশ করেছিল তারা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সুইং রাজ্যে করা তাদের জনমত জরিপের ফল সঠিক হয়েছিল।
মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের জরিপ অনুযায়ী, এবারে হোয়াইট হাউসের দৌড় অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে। জনমত জরিপে নেভাদা, নর্থ ক্যারোলিনা এবং উইসকনসিনে সামান্য ব্যবধানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারিস। আর অ্যারিজোনায় এগিয়ে আছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিশিগান, জর্জিয়া এবং পেনসিলভানিয়াতেও দু’জনের মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলেছে।
ফলে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটারই ইতোমধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন। আর আগাম ভোট দেওয়াদের মাঝে ট্রাম্পের চেয়ে ৮ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন কমালা হ্যারিস। তবে এখনও যারা ভোট দেননি তাদের মাঝে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক বেশি দেখা গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমের জরিপ অনুযায়ী, পেনসিলভানিয়া রাজ্যেও এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের চেয়ে চার পয়েন্টে এগিয়ে আছেন হ্যারিস। তবে এই রাজ্যে পূর্বের তুলনায় ট্রাম্পের পক্ষে জনগণের মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে।
রোববার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের চূড়ান্ত জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দুই প্রার্থীই—ট্রাম্প আর হ্যারিস—প্রত্যেকে ৪৯ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন।
গত অক্টোবর থেকেই তুলনামূলকভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে এনবিসির জরিপ। অক্টোবরে প্রকাশিত ফলাফলেও এই দুই প্রার্থীর সমান ৪৮ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছিলেন।
জরিপে দেখা যায়, কমালা হ্যারিসকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নেওয়ার জন্য যেসব বিষয় ভূমিকা রাখতে পারে, সেগুলো হলো গণতন্ত্রকামীদের উত্থান, গর্ভপাত ইস্যুতে তার অবস্থান এবং মধ্যবিত্তের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ।
মার্কিন নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জনমত জরিপের ফল দেখা গেছে আইওয়া রাজ্যে। ঐতিহ্যগতভাবেই এই রাজ্যটি রিপাবলিকান হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনের আগের দিনের প্রকাশিত ডেস মইনেস রেজিস্টার ও মিডিয়াকমের প্রকাশিত জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, আইওয়া রাজ্যে ৪৭ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। আর রিপাবলিকান ভূস্বর্গ-খ্যাত রাজ্যটিতে দলটির প্রার্থী ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।
এই রাজ্যের ভোটারদের মাঝে হ্যারিসের প্রতি সমর্থনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জরিপে এই রাজ্যের ভোটারদের প্রায় ৪৭ শতাংশ ট্রাম্পকে এবং হ্যারিসকে ৪৩ শতাংশ সমর্থন দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গত চারটি নির্বাচনেও আইওয়াতে ভোটদানের মিশ্র রেকর্ড দেখা গেছে। ২০০৮ এবং ২০১২ সালে বারাক ওবামার জন্য নীল রঙে ছেয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৬ এবং ২০২০ সালের নির্বাচনে আবারও রিপাবলিকান হয়ে ওঠে আইওয়া; জয় পান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নতুন জনমত জরিপে দেখা গেছে, রাজ্যের নারী ভোটারদের বৃহৎ অংশ ট্রাম্পের তুলনায় কমালা হ্যারিসের পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। আইওয়ার নারী ভোটারদের সমর্থনের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশই হ্যারিসকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন আর ৩৬ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। রাজ্যটিতে পুরুষ ভোটারদের সমর্থনে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। ৫২ শতাংশ পুরুষ তার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন; যা হ্যারিসের ক্ষেত্রে মাত্র ৩৮ শতাংশ।
তবে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব জনমত জরিপের ফল উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, আইওয়া রাজ্যে কৃষকদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় কোনও প্রেসিডেন্টই বেশি কিছু করেননি। এমনকি এসব জনমত জরিপের ফল খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণও নয়।
ট্রাম্প বলেছেন, আমি কৃষকদের ভালোবাসি, তারাও আমাকে ভালোবাসেন। তারা আমাকে বিশ্বাস করেন। আইওয়া রাজ্যের ৮৫ শতাংশ ভূমিই কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেকোনও রাজ্যের তুলনায় আইওয়াতে ভুট্টা, শূকর, ডিম, ইথানল এবং বায়োডিজেলের উৎপাদন বেশি হয়।
শেষ মুহূর্তের অন্যান্য জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, আইওয়াতে যদি কমালা হ্যারিস শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র করে তুলতে পারেন, তাহলে মার্কিন নির্বাচনের পুরো প্রতিযোগিতার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে পারে।
আগামীকাল ৫ নভেম্বর দেশজুড়ে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ট্রাম্প এবং কমালা হ্যারিসের জন্য আজই নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন। একেবারে শেষ সময়ে এসে উভয় প্রার্থীই ভোটারদের মন জয়ে চূড়ান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় রোববার মিশিগানে শেষ সময় কাটিয়েছেন কমালা হ্যারিস; যেখানে তিনি গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধের অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে, বৃহৎ তিন সুইং রাজ্য পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়া চষে বেড়াচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পেনসিলভানিয়ার লিটিজে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের গুলি করা হলে তিনি কিছু মনে করবেন না।
গত জুলাইয়ে অল্পের জন্য গুপ্তহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, তাকে আবারও গুলি করা হতে পারে। আর সেই গুলি আসতে পারে ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে। তবে আমি এটা নিয়ে খুব বেশি কিছু মনে করবো না।