19 C
Dhaka
Friday, December 6, 2024

ছলচাতুরীতে একশতে একশ অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান

রাজধানীর পুরান ঢাকার শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ। ২০১৫ সালে কলেজটির অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান। তারপর থেকে পাল্টে যায় চিত্র। স্বনামধন্য এই কলেজে একে একে কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে চলতি বছরের ৩০ মার্চ বিদায় নেন তিনি। অধ্যক্ষ থাকাকালীন আব্দুর রহমানের দুর্নীতি-অনিয়মের ফিরিস্তি বেশ লম্বা। আর্থিক দুর্নীতি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, এমপিও, টিএমআইএস জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সাধারণ শিক্ষকদের হয়রানিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দুই বছর অবৈধভাবে পদে থেকেছেন।

অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কোনো শিক্ষক প্রশ্ন তুললে তাকে নানা অজুহাতে হয়রানি ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। ছাত্রীদের দিয়ে কৌশলে মানহানির অভিযোগ তুলে কোনো শিক্ষককে কলেজ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আবার অর্থের বিনিময়ে দোষীদের নির্দোষ সাজিয়ে চাকরিতে বহাল করতেন আব্দুর রহমান। কলেজ সিন্ডিকেট শিক্ষকরা সাধারণ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটিয়েছেন। সাবেক অধ্যক্ষের এমন নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষকরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কেউ অধ্যক্ষের পদে থাকলে সেটা অনিয়ম। অনিয়মের প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও কলেজের জমি কেনার বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ শুনেছি। এ বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নেব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, কেউ অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কলেজের জমি ক্রয়ে অনিয়ম: ঢাকার কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নে ২০১৯ সালে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ৪৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ জমি বুঝে পায়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী চেকের মাধ্যমে লেনদেনের কথা থাকলেও নগদে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিন কোটি ৮৬ লাখ টাকা তার নামে চেকে উত্তোলন করেন। অভিযোগ আছে, নগদ লেনদেনের পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেন আব্দুর রহমান এবং তার সহযোগী জমি ক্রয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু নাঈম মো. রাফি, রাফির ব্যবসায়িক অংশীদার শাহ আলম। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেনা হলেও তাদের সম্পূর্ণ টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আছে। সারা রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে বলা হলেও প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদনকৃত কাগজপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া ৯২ শতাংশ জমির দলিল মূল্য ১ কোটি ৯২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। জমি ক্রয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু নাঈম মো. রাফি এ জমির দলিল যে দপ্তরে জমা দিয়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে এখনো ক্রয়কৃত জমির নামজারি হয়নি। এমনকি ডিআইএ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেননি অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান।

আরো পড়ুন  জানা গেল সেই ‘ভারতীয় তরুণীর’ পরিচয়

অধ্যক্ষের বাণিজ্য: গভর্নিং বডির সভাপতি সম্মানী বাবদ পান ১৮ হাজার টাকা। সদস্যরা পান ১২ হাজার টাকা। শুধু কমিটির সম্মানী বাবদ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে। ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেন অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান। বিষয়টি জানাজানি হলে কলেজ পরিচালনা পরিষদ তার কাছে জবাব চান। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বললেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী আইডিয়াল কলেজকে সে অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালে শাহজালাল ব্যাংকে কলেজের ১০ কোটি টাকার এফডিআরের মেয়াদ প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও নবায়ন না করায় কলেজ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। তৎকালীন কলেজ পরিচালনা পরিষদ চাপ প্রয়োগ করায় ব্যাংক থেকে ১৮ লাখ টাকা (কথিত) ক্ষতিপূরণ আনেন। অধ্যক্ষের জ্যেষ্ঠ কন্যা রুবাইয়া রহমান রুপন্তীকে চাকরি দেওয়ার শর্তে একটি ব্যাংকে কলেজের ২৫ কোটি টাকার এফডিআর করেন। এ ছাড়া নবীনবরণ, ক্রীড়া, মিলাদ মাহফিল, বিদায় অনুষ্ঠানের নামে তিনি বিভিন্ন সময়ে বড় অঙ্কের খরচ দেখান, যার বেশিরভাগ টাকা আব্দুর রহমানের পকেটে যেত।

আরো পড়ুন  নতুন দল গঠন নিয়ে যা জানালেন সমন্বয়ক সারজিস

২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অমান্য করে ২০১৯ সালে তিনি ৪৫ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। এ নিয়োগে কলেজের ব্যয় দেখানো হয় ১৪ লাখ টাকা। ডিআইএর রিপোর্ট অনুযায়ী এ নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। অথচ আইন ভঙ্গ করে আবারও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থিক সুবিধা নিয়ে কঠোর গোপনীয়তায় ১৯ জনকে স্থায়ী নিয়োগ দেন। এ নিয়োগের জন্য ১১টি বোর্ড গঠন করে প্রায় ১৩ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এনটিআরসিএ এমপিও এবং নন-এমপিও শিক্ষকের চাহিদাপত্র চেয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার পরও এমপিও পদ শূন্য রেখে এই পদগুলোর বিপরীতে কলেজ সৃষ্ট পদে শিক্ষক নিয়োগ দেন সাবেক অধ্যক্ষ। এ নিয়োগের জন্য বোর্ড গঠন করে অর্থ গ্রহণ এবং নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষককে কলেজ তহবিল থেকে বেতন প্রদান করায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। যোগ্য অনেক শিক্ষককে পদোন্নতি না দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বারবার নীতিমালা পরিবর্তন করে নিজের পছন্দের শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়েছেন।

কলেজের নিজস্ব জমির সোলেনামা চুক্তি অনুযায়ী যে অর্থ প্রদানের কথা ছিল, তা থেকে আরও ৭০ লাভ টাকা বেশি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে। দরপত্র ছাড়াই উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ১৫টি বিভাগ উন্নয়ন, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন স্থাপন, রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই পূর্ব ভবন ঊর্ধমুখী সম্প্রসারণ ইত্যাদি। কৌশলে ২০১১ সাল থেকে শিক্ষকদের অনার্স-মাস্টার্স ভাতা বন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতাবলে প্রতি মাসে ভাতা নিয়েছেন তিনি। অথচ ২০১০ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত একটি ক্লাসও নেননি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, অধ্যক্ষের প্রভাব খাটিয়ে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় তিনি নিয়মিত অধ্যক্ষের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা নেন। যাতায়াতের জন্য কলেজের যে গাড়ি ব্যবহার করেন, সেই গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। পরিবার থেকে শুরু করে সব কাজে এ গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। গাড়ি ব্যবহারের খরচ দেখিয়ে প্রতি মাসে লাখ টাকা আদায় করেছেন। গাড়ি ব্যবহার করা সত্ত্বেও যাতায়াত ভাতা গ্রহণ করতেন অধ্যক্ষ। ২০২১-২২ ও ২৩ করবর্ষে কলেজের গাড়ির ট্যাক্স নিজের ব্যক্তিগত আয়করের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখিয়েছেন। স্ত্রী নাসিমা মমতাজ একজন গৃহিণী। তার ব্যক্তিগত আয় নেই। এর পরও তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স ফাইলে দেখিয়ে থাকেন। এই অর্থের মূল উৎস হলো আব্দুর রহমানের অবৈধ উপার্জন। অধ্যক্ষ তার নিজের আয়কর ফাইলে কখনো স্ত্রীর টিআইএন নম্বর উল্লেখ করেন না। কলেজ থেকে প্রতি মাসে বেতন-ভাতাসহ ১ লাখ ৭৪ হাজার ২১০ টাকা নিতেন আব্দুর রহমান। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কোনো ক্লাস না নিয়েও শুধুমাত্র রুটিনে নাম অন্তর্ভুক্ত করে নিয়মিত বিল নিতেন।

আরো পড়ুন  মুগ্ধর মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সিং প্রতিষ্ঠান ফাইভারের শোক

বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক: উত্তরায় (২৫ শাহ মখদুম অ্যাভিনিউ, সেক্টর-১৪) বাড়ি, পূর্বাচলে একাধিক প্লট, ময়মনসিংহ শহরে ১০ শতাংশ জমি, দুটি প্লট রয়েছে আব্দুর রহমানের। তার একমাত্র ছেলে সিয়াম খানকে কানাডার আলবার্টা ইউনিভার্সিটিতে সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে তার স্ত্রীসহ নামে-বেনামে একাধিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে।

যা বললেন অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান: তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান। কালবেলাকে তিনি বলেন, সাড়ে ১০ কোটি টাকা খরচ করে সারা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মাধ্যমে কেরানীগঞ্জে জমি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু জমি কৃষকদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে। নগদ ও চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু আমি নই, সব কলেজেই অধ্যক্ষের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পদে থাকেন। আমিও অধ্যক্ষের পদে দুই বছর ছিলাম, বেতন-ভাতাও গ্রহণ করেছি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গভর্নিং বডির সম্মানী খরচ ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা কথা বলা হয়েছে, তার কাগজপত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ