20 C
Dhaka
Monday, November 18, 2024

সুদহার বাড়িয়েও আমানত টানতে পারছে না ব্যাংক

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। এতে নীতি সুদহারসহ সব ধরনের সুদ অব্যাহতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। তা সত্ত্বেও ব্যাংকে বাড়ছে না আমানত। গত পাঁচ মাসের মধ্যে মার্চে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়েছে। কারণ, মানুষের হাতে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। গত মার্চ মাসেই ব্যাংকের বাইরে মানুষের কাছে নগদ টাকা বেড়েছে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখনো মূল্যস্ফীতির দাপট রয়েছে। যে কারণে মানুষের সঞ্চয় করার প্রবণতা আগের চেয়ে কমে গেছে।

এ ছাড়া সম্প্রতি ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে অনেক মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে ফেলছে। ফলে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার পরিমাণ বাড়ছে। তাদের মতে, এত পরিমাণ টাকা ব্যাংকের বাইরে রেখে কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং চলতি আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

আরো পড়ুন  দুপুর ১টার মধ্যে যেসব অঞ্চলে ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, যা ছিল বিগত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এর আগে করোনা মহামারির সময়ে বৈশ্বিক মন্দায় পড়ে অর্থনৈতিক গতি মন্থরতার প্রভাবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল।

আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। ফলে ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে নিজেদের বিনিয়োগ কমিয়ে এনেছে। যেসব বিল-বন্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো নবায়ন করেনি। আবার মেয়াদ পূর্ণ হয়নি—এমন অনেক বিল-বন্ডও ব্যাংকগুলো নগদায়ন করে ফেলছে। সেই সঙ্গে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলো সাধারণত ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে সুদহার দিচ্ছে আমানতকারীদের। অন্যদিকে সংকটে থাকা অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।

এদিকে গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে নীতি সুদহারও ৮ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করেছে।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘২০২২ সাল বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতি নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে পার করেছে, যা ২০২৩ সালেও বহাল ছিল। সংকটগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের ওপরও। এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রা চলে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এ ছাড়া, নেতিবাচক বিভিন্ন সংবাদের কারণে কিছু গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো অর্থ থাকছে না। বরং অনেকে ব্যাংকে থাকা নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন। এ ছাড়া বর্তমানে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে মানুষের হাতে সঞ্চয় থাকছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংকে আমানত কিছুটা কমে গেছে। তবে বর্তমানে টাকা ডলার সোয়াপ পদ্ধতি চালু হওয়ায় এবং সুদহার বাড়ায় ব্যাংকের আমানত ধীরে ধীরে বাড়ছে। আশা করি, আগামীতে তা আরও বাড়বে।’

আরো পড়ুন  ভারতের সেভেন সিস্টার্স : বাংলাদেশের কী লাভ, কী ক্ষতি

তবে আরেকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘যেসব ব্যাংক নিয়ে বাজারে ইতিবাচক মনোভাব আছে, সেসব ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে গ্রাহকরা দুর্বল ব্যাংক থেকে ডিপোজিট তুলে এনে ভালো ব্যাংকে রেখেছেন। ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অন্যদিকে ভালো ব্যাংকের আমানত আরও বেড়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সিদ্ধান্তের পর ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। ফলে ব্যাংকটি তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। একই অবস্থায় রয়েছে দেশের আরও প্রায় ডজনখানেক ব্যাংক।

আরো পড়ুন  ৭ অঞ্চলে ঝড়ের পূর্বাভাস, সতর্ক সংকেত

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে যা ঘটছে, এতে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে যাচ্ছে। ফলে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত মানুষের হাতে থাকা টাকার (কারেন্সি আউট সাইড ব্যাংক) পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারির তুলনায় তিন হাজার ৬২১ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। গত বছরের মার্চ মাস শেষে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো দেশে দুর্নীতি বাড়লে সেখানে নগদ অর্থের চাহিদাও বাড়ে। বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই ঘুষ, দুর্নীতিসহ কালো টাকার দৌরাত্ম্য বাড়ছে। নির্বাচনের আগে ও পরে এ ধরনের লেনদেনই নগদ টাকায় হচ্ছে। এ কারণে এখানে নগদ অর্থের চাহিদা কমছে না, বরং বাড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায় নগদ অর্থের চাহিদা কমে আসছে; কিন্তু আমাদের দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ব্যাংক খাতের ব্যাপ্তি অনেক বড় হলেও নগদ টাকার চাহিদা কমছে না। এটি অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতের ব্যর্থতা।’

সর্বশেষ সংবাদ