24 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

‘কখন স্ত্রী-সন্তানসহ মরে যাই, সেই ভয়ে থাকি’

কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড় কেটে ব্লক তৈরি করে ঢালে ঢালে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ আশ্রয়শিবিরে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার জীবন। বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। এরই মধ্যে টানা কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের।

রোহিঙ্গারা বলছেন, বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের আতঙ্কে তাদের দুই চোখে ঘুম নেই। তবে রোহিঙ্গাদের সচেতন করার পাশাপাশি অতি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

বুধবার (১৯ জুন) টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে উখিয়ার মেগা ক্যাম্প-১০ এ পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে একই পরিবারের ৪ জনের। তারপর পাহাড় ধসের স্থানে দেয়া হয় ত্রিপল।

পাহাড় ধসের ঠিক পাশেই বসবাস করছেন আজম শাহ ও ইসমাইলের পরিবার। তাদের বসতির সামনে পাহাড় ধসের স্থান ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তারা দুজনই বলছিলেন, বৃষ্টি হলেই ভয় লাগে তাদের।

আজম শাহ বলেন, বৃষ্টি হলেই ভয় লাগে। কারণ পাহাড়ের খাদে বসবাস করি। এরই মধ্যে বসতির সামনে পাহাড়ের বিশাল একটি অংশ ধসে পড়ে গেছে। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। পাহাড় চাপা পড়ে কখন স্ত্রী-সন্তানসহ মরে যাই, সেই ভয়ে থাকি।

আরো পড়ুন  নাফ নদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা

মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, পাহাড় ধসে আমার বসতির পাশেই একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই বসতির পাশে কয়েকটি পাহাড় রয়েছে। যেখানে একেকটি পাহাড়ের ব্লকে ১০০, ৫০, ৬০ ও ৭০টির মতো বসতি রয়েছে। সবাই পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে।

কক্সবাজারের উখিয়ার ক্যাম্প ৯ ও ১০ এ রয়েছে অসংখ্য পাহাড়। এসব পাহাড়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পরিবার। আর ক্যাম্পের অধিকাংশ জমির অবস্থা খুবই খারাপ। বুধবারও ১, ৮, ৯, ১০ ও ১৪ ক্যাম্পে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে দুজন স্থানীয় বাসিন্দাসহ ১০ জন রোহিঙ্গার। এমন অবস্থায় বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছেন রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্প ৯ এর বাসিন্দা মরিয়ম বলেন, পাহাড়ের উপর ঘর নির্মাণ করেছি। এখন পাহাড়ের উপরেও ঘর, নিচেও ঘর। উপর থেকে পাহাড় ধসে নিচে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।

একই ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা সিরাজ বলেন, বৃষ্টি হলেই তো ভয়। পাহাড় ধসে পড়বে এই আশঙ্কায় থাকি।

ক্যাম্প-১০ এর সি ব্লকের বাসিন্দা দিলদার বলেন, ক্যাম্পের জীবন বেশি কষ্টের। কারণ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করতে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আমরা খুবই ভয়ের মধ্যে আছি।

আরো পড়ুন  সাত বছর পর চাকরি ফিরে পেলেন দুই শিক্ষক

একই ক্যাম্পের বাসিন্দা আলম বলেন, ক্যাম্পে তো জায়গা কম, খুবই ঘনবসতি। এখন পাহাড়ে না থেকে যাবে কোথায়?

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বর্ষা মৌসুমে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় মাইকিং করে নিরাপদে স্থানে সরিয়ে নেয়া হয় রোহিঙ্গাদের। কিন্তু একদিকে সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে পালিয়ে ফের বসতিতে চলে আসে তারা। আর প্রবল বর্ষণ হলেই পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।

কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা বলেন, ভারি বর্ষণ হলেই ক্যাম্পে মাইকিং করা হয় এবং সচেতন করা হয়। একই সঙ্গে অতি ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে লার্নিং সেন্টারগুলো নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তারা তা মানে না। নিরাপদ লার্নিং সেন্টারে আনলেও কিছুক্ষণের মধ্যে তারা পালিয়ে যায়। আমরা রোহিঙ্গাদের বুঝিয়ে সরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কত রোহিঙ্গা পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য নেই। কারণ এখানে এতো ঘনবসতি। সবই তো পাহাড়ি টিলার উপর গাদাগাদি করে থাকছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কত রোহিঙ্গা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে এটির একটি তালিকা তৈরি করতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরো পড়ুন  টাঙ্গাইলে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

তবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার জানালেন, পাহাড় ধসের শঙ্কায় ঝুঁকিতে থাকা ৫০০ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আর অতি ঝুঁকিতে থাকা আরও কয়েকশ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া হবে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, মূলত পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ৮ ইস্ট, ৯ ও ১০ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দারা। এছাড়াও ১৪ নম্বর ক্যাম্পেরও কিছু এলাকা রয়েছে। এসব ক্যাম্পে অনেক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এখানে তো স্থানের সংকট রয়েছে। চাইলে তো অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। মাত্র ৮ হাজার একর জায়গার মধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে। চাইলে আমরা তাদেরকে স্থানান্তর করতে পারি না। এরই মধ্যে ঝুঁকিতে থাকা ৫০০ জন রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি অতি ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদেরও সরিয়ে নেয়া হবে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৮ ও ১৯ সালে ক্যাম্প ৯ ও ১০ থেকে পাহাড় ধসে ঝুঁকিতে থাকা ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ