গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের মানুষকে নতুন করে আলোর সন্ধান দিয়েছে ছাত্রসমাজ। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তারা জানিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত করে না। তারুণ্যের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যেতে বাধ্য যে কোনো অন্যায়। শুধু সরকার পতন ঘটিয়েই থেমে যায়নি তাদের প্রয়াস। দেশ গড়ার কাজেও নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে শিক্ষার্থীদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করতে হয়— শিক্ষার্থীরা তা দেখিয়ে দিয়েছেন। বহু দিন ধরে চেষ্টা করেও রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ যা করতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে ছাত্রসমাজ।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছে, তারুণ্যে কোনো বাধা মানে না। নিজেদের দ্রোহ, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্যমে পৃথিবীকে বদলে দেয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতন তারই প্রমাণ দেয়। তরুণ শিক্ষার্থীদের ডাকে সারাদেশে সব শ্রেণির তরুণ, অভিভাবক, পিতা-মাতা, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী রাস্তায় নামেন। সেই আন্দোলনে সফল হয়েছেন দেশের শিক্ষার্থীরা। তরুণরা শুধু সরকার পতন করে দেশে নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত করছেন, তা নয়। তারা দুঃশাসন, দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে জাতিকে একটি বার্তা দিয়েছেন, ঘুম থেকে জাগ্রত করেছেন। অনিয়ম ও অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ জমা হলেও দীর্ঘদিন তারা প্রকাশ করতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের বিদ্রোহ সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অন্যায় করে যে পার পাওয়া যায় না—শিক্ষার্থীরা সেই বার্তা দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল সমালোচনা করলেও, কেউ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট থেকে দেশকে রক্ষা করছেন। এখন তাদের প্রত্যাশা, গণতন্ত্রের মোড়কে যেন আর কোনো স্বৈরতন্ত্র না হয়। পতিত সরকারের আমলে কতিপয় রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। তাদের হাতে গোটা দেশটা জিম্মি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতির আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেইসঙ্গে তরুণদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে দুঃশাসন, দুষ্কর্ম, দুর্নীতি, জুলুম-নির্যাতন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছিল। এ কারণে তাদের পতন হয়েছে। দেশে এখন গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যেন আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর দুঃশাসন, জুলুম-নির্যাতন করতে না পরে। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, পাকিস্তান আমলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশটির জন্ম, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সেই দেশে বৈষম্য দূর হয়নি। দেশ পরিবর্তন করতে হলে মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন আগে দরকার। এখন যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মিলে দল বেঁধে রাস্তা পরিষ্কার করছেন, ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দামের দিকে দৃষ্টি রাখছেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। দেশের সাধারণ মানুষের যা চাওয়া ছিল, তা-ই করছেন শিক্ষার্থীরা। এসব যেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য না হয়। সামনে প্রশাসন যেন দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। কোনো দলের হাতিয়ার হিসেবে যেন ব্যবহার না হয়। দেশের মানুষকেও আইন মেনে চলতে হবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলদাসত্বমুক্ত দেশ হতে হবে। আর যদি কোনো দল আবার সাধারণ মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে তাহলে সেটা প্রতিরোধ করতে হবে। এখন দেশের মানুষ জাগ্রত। দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা। চাটুকারিতার দিন শেষ, কারও অন্যায় জুলুম মেনে নেবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জহির রায়হান কালবেলাকে বলেন, ‘এদেশে জনগণের সঙ্গে জুলুম করে কেউ আর পার পাবে না। সেই বার্তা দিয়েছেন আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো দলের নয়, প্রশাসনকে জনগণের জন্য কাজ করত হবে।’
তিনি বলেন, ‘স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নিজেরা আগ্রহী হয়ে সবাই মিলে দল বেঁধে রাস্তা পরিষ্কার করছি, ট্রাফিক আইন মানতে শিখিয়েছে, বাজারে জিনিসপত্রের দামের দিকে দৃষ্টি রাখছে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। এটা সাধারণ মানুষের চাওয়া ছিল, তাই করছেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা দেশে যে দৃষ্টি স্থাপন করেছেন, সেটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। একইসঙ্গে আমরা প্রতিটি হত্যার বিচার চাই। শিক্ষার্থীরা মূলত দেখিয়েছে নিরস্ত্র অবস্থায় কীভাবে সকল শ্রেণি-পেশার দলমত নির্বিশেষে মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি ন্যায়সংগত যৌক্তিক অধিকার এবং দাবি আদায় করা যায়।’
ঢাকা কলেজ ম্যানেজমেন্ট বিভোগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. রাকিব খান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা দেশের জন্য আন্দোলন করছি। সেটা সফল হয়েছে। এখন প্রশাসন মাঠে নাই, তাই আমরা দায়িত্ব নিয়ে মানুষের জন্য কাছ করছি। সড়কে নিয়ম মেনে চলতে অনুরোধ করছি সবাই মানতে চায় না। তবে সড়কে অনেক শৃঙ্খলা আসছে।’
নীলক্ষেত স্কুলের শিক্ষার্থী তাহমেদ ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের মানুষের সঙ্গে কেউ অন্যায় করলে, দুর্নীতি করলে তাদের বিচার করতে হবে।’