পঁচাত্তর বছর বয়সি মোছা. হাসিনা বানু একজন সংগ্রামী মা। তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন তার বড় পরিচয় তিনি একজন রত্নগর্ভা। দুসন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন; যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বড় ছেলে আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এনামুল হক এবং মেয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ আমিনা পারভীন।
রোববার (১২ মে) বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে সংগ্রামী এ মায়ের জীবনের গল্প সময় সংবাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মোছা. হাসিনা বানুর জন্ম ১৯৪৯ সালের ৮ মার্চ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর গ্রামে। বাবা হারেজ উদ্দীন মালিথা উত্তরাধিকার সূত্রে ছিলেন জমিদার। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় এবং মেয়েদের দিক থেকে বড়; ছিলেন দাদা-দাদির আদরের নাতনি। প্রাথমিক পড়াশোনার গণ্ডি পেরোনোর পরই পাশের গ্রামের প্রশংসনীয় গুণসম্পন্ন এবং মেধবী মুখ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আশরাফ আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
মোহাম্মদ আশরাফ আলী ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক। তাদের বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র চার বছর চার মাস। স্বামীর মৃত্যুর পরই হাসিনা বানুর কপালে নেমে আসে দীর্ঘ সংগ্রামের পথরেখা। কারণ স্বামীর মৃত্যুর সময় হাসিনা বানুর কোলে ছিল দুই সন্তান, যাদের বয়স একজনের দুইবছর এবং আরেকজনের সাতদিন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মোছা. হাসিনা বানুর দুই সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান (ছেলে) ড. মো. এনামুল হক ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিল। মায়ের সংগ্রামে সবসময় সুন্দর দৃষ্টিতে সাড়া দিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগ থেকে কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম পজিশন অর্জন করেন। এটি ছিল তৎকালীন সময়ে ওই বিভাগের সেরা রেজাল্ট। স্নাতক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে মলিকুলার বায়োসায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা করছেন ড. মো. এনামুল হক।
অন্যদিকে ছোট সন্তান অধ্যাপক আমিনা পারভীন (মেয়ে) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এছাড়া ২০০৭ সালে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স অফ সাইন্স ইন সোশাল ওয়ার্ক (আইএমএসএসডব্লিও) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল শাবিপ্রবির সমাজকর্ম বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
অধ্যাপক আমিনা পারভীন শাবিপ্রবির শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি, হল প্রাধ্যক্ষ, সিন্ডিকেট সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ও সমাজকর্ম বিভাগের প্রধানসহ প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বকালেই তার ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে আরেকটি নতুন দায়িত্ব চলে আসে। তিনি শাবিপ্রবির প্রথম নারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে চেয়ারটির দায়িত্ব সফলভাবেই পালন করছেন তিনি।
রত্নগর্ভা মোছা. হাসিনা বানু বলেন, ‘বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকায় হয়তো কষ্ট কম হয়েছে। তবে দীর্ঘ সংগ্রাম করে চলতে হয়েছে সবসময়। এর একটাই কারণ ছেলেমেয়েকে মানুষ করা। মনে অদম্য জেদ ছিল, যেকোনো মূল্যে ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করবো। কেউ যেন বলতে না পারে আমি নিজে বেশি লেখাপড়া করিনি বলে আমার দুই সন্তানকেও শিক্ষিত করতে পারিনি। আমি আমার জেদকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি শুধুমাত্র আমার দুই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে।’
হাসিনা বানুর মেয়ে অধ্যাপক আমিনা পারভীন বলেন, ‘আজ আমি যেখানে অবস্থান করছি, সেখানে আসার পেছনে আমার মায়ের অবদান অপরিসীম। ছোটবেলা থেকে শিক্ষাজীবনের সব গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমান সময়ে পৌঁছাতে চারপাশের নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে। আমার মায়ের যোগানো সাহসই সেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার মায়ের দেখানো পথকেই অনুসরণ করেছি। একই সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মনে হয়, নারীর ক্ষমতায়ন নিজের ঘর থেকেই শুরু হয় এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম সোপান আমরা নারীরা কেবল আমাদের মায়ের হাত ধরেই শিখে থাকি।’