দেশের চক্ষু হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের মতো টিকিট কেটে চিকিৎসা নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সপ্তাহে ছুটির দিনেও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে (এনআইও) চিকিৎসা নিয়েছেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা কার্যক্রম নিরাপত্তাজনিত কারণে এমনিতেই স্পর্শকাতর। অথচ তাকে চিকিৎসাসেবা দানকারী এই চিকিৎসক দলে রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডা. আক্তারুজ্জামান লিকু। প্রতিনিধিদলে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচনার তীর হাসপাতালের পরিচালক ডা. গোলাম মোস্তফার দিকে। একই চিকিৎসক দলে বিএনপির পেশাজীবী সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্তিতে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ত্রুটি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
এনআইওতে চিকিৎসক এবং এর সঙ্গে সেবাদানকারীদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের মদদদাতা হিসেবে হাসপাতালের পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। পরিচালক গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও। অদৃশ্য ক্ষমতাবলে চতুর্থবারের মতো পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। আর এই ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন হাসপাতালের সর্বক্ষেত্রে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী চোখের নিয়মিত পরীক্ষা করতে হাসপাতালটিতে আসেন গত ৩ মে। এ উপলক্ষে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যদের সমন্বয়ে ১১ জনের একটি দল গঠন করা হয়। এই দলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক, ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, এনআইও হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মোস্তফা, ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, ডা. গোলাম রসুল, ডা. শহিদুল ইসলাম,ডা. আক্তারুজ্জামান লিকু ও ডা. মাহবুবুল হক সজল। হাসপাতালের পরিচালক এই তালিকা লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের কাছে হস্তান্তর করেন। পরিচালকের ‘অপত্য স্নেহের’ ফলে এই তালিকায় ঢুকে পড়েন ডা. আক্তারুজ্জামান লিকু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিকু হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (উপপরিচালকের চলতি দায়িত্ব) হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি পড়ালেখা শেষ করেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে। সেখানে তিনি ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন। যদিও লিকু দাবি করেছেন, তিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তবে তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও সে সময়ের অগ্রজ-সহপাঠী-অনুজদের অন্তত ১০ জন নিশ্চিত করেছেন, ওসমানী মেডিকেল কলেজে তিনি ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক কারণে লিকু এমবিবিএস পাস করলেও নিজ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইন্টার্ন শেষ করেননি। দুই ব্যাচ পরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইন্টার্ন সমাপ্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা দলে থাকার বিষয়ে স্বীকার করে আক্তারুজ্জামান লিকু কালবেলাকে বলেন, ‘ছুটির দিনে বাড়তি দায়িত্ব পালন করেছি। পরিচালক চেয়েছেন বলেই আমি সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হই। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দলের কাছে আমাদের তালিকাও দেওয়া হয়।’ তবে ওসমানী মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন না বলে দাবি করেন তিনি। লিকু বলেন, ‘সে সময় হলে থাকতে হয়েছে বলে যতটুকু রাজনীতি করার প্রয়োজন ততটুকু করেছি। এখন আর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না, বিষয়টা দুঃখজনক।’
সে সময়ের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি অনিমেষ মিত্র কালবেলাকে বলেন, ‘২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের মেডিকেলে ছাত্রদলের তিনজনের একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে সভাপতি ছিলেন ৪২তম ব্যাচের আক্তারুজ্জামান লিকু। ৪৩তম ব্যাচের আবু সালেহ রানা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং ৪৪তম ব্যাচের সানীকে মনোনীত করা হয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে।’
একই মতামত ব্যক্ত করেছেন তৎকালীন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্লোল দে। তিনি বলেন, ‘সে সময় তো আর ফেসবুক এতটা জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু আমরা যারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতাম, তারা সবাই জানি কারা ছাত্রদল করতেন। লিকু সভাপতি ছিলেন এটা নিশ্চিত।’
এদিকে এনআইওর একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক কালবেলাকে বলেছেন, এখানে মূলত বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের রাজত্ব চলছে। এর পেছনে রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান পরিচালক। তিনি ছাড়া যেন দেশে কোনো চক্ষু বিশেষজ্ঞ নেই। একজনই বারবার পরিচালক নিযুক্ত হচ্ছেন। অথচ চাকরি থেকে তার অবসরের বয়স ৭-৮ বছর আগেই পেরিয়ে গেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই দলে একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ড্যাব থেকে পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনের অভিযোগ রয়েছে। অন্য একজন ড্যাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তিনি বিএনপি সরকারের সময় থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য একজনের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাও ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি টানা চতুর্থ মেয়াদে এনআইওতে পরিচালক পদে নিয়োগ পান ডা. গোলাম মোস্তফা। দুই বছরের জন্য তাকে আবারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল দুই বছরের জন্য চুক্তিতে হাসপাতালটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এরপর তিনবারই তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মোস্তফা কালবেলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকলে আমি তাদের চিকিৎসা দলে রাখতাম না। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি হোক—এমন কিছু তো আমি চাইব না। যারা কাজ পারেন না তারা প্রফেশনাল জেলাসি থেকে এসব অভিযোগ করেন।’
ছাত্রদলের সভাপতি, ছাত্রশিবির ও ড্যাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এসব প্রসঙ্গে কিছু জানি না। এসব সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তারা কীভাবে পদন্নোতি পায়, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা কী করে?’
বারবার পরিচালকের পদে নিয়োগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো অদৃশ্য ক্ষমতা নেই। কাজ ভালো পারি, তাই আমাকে এখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো তদবির করার দরকার পড়েনি।’