কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের বি ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারের খুন হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, টুকরো টুকরো করার পর ওই ফ্ল্যাটটি থেকে ট্রলি ব্যাগে করে এমপি আনারের মরদেহ সরিয়ে ফেলেন খুনিরা। অবশ্য সেই ট্রলি ব্যাগে আনারের মরদেহ কোথায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, এর উত্তর জানতে একাধিক সূত্র ধরে তল্লাশি অভিযান-তদন্ত চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ।
পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল অনলাইন রেন্টালের মাধ্যমে একটি গাড়ি ভাড়া নিয়েছিল খুনিরা। গত ১৩ মে আনারকে হত্যা করে তার শরীরকে টুকরো করা হয়। পরে ১৪ মে মরদেহের কিছু অংশ ট্রলি ব্যাগে করে ওই ভাড়া গাড়িতে তোলেন এক নারী ও দুই ব্যক্তি।
এদিকে, সিসিভিটি ফুটেজ দেখে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি জানিয়েছে, এক্সেস মলে নামানোর আগে নজরুল তীর্থের কাছে গাড়িটি ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় আনারের দেহাংশ কোথায় ফেলা হবে, তা নিয়ে গাড়ির মধ্যেই আলোচনা হয়। এরপর তাদের এক্সেস মলের সামনে নামিয়ে দেন চালক। সিআইডি মনে করছে, চালক অনেক কিছুই জানে কিন্তু যা তিনি বলছেন না। তদন্তের স্বার্থে ওই চালককে আটকে রেখেছে পুলিশ।
সঞ্জীবা গার্ডেনের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কলকাতা পুলিশ বলছে, ১৩ মে ওই ফ্ল্যাটে তিনজন একসঙ্গে ঢোকেন। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। একদিন সেখানে অবস্থানের পর ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আসেন এক পুরুষ ও এক নারী। ধারণা করা হচ্ছে, ওই নারী হলেন শিলাস্তি। এমপি আনারকে ওই ফ্ল্যাটে নিতে তাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। ১৩ মে তিনি আমানুল্লাহ ও এমপি আনারের সঙ্গে ফ্ল্যাটে ঢুকে থাকতে পারেন।
জানা গেছে, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরের দিন, ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি।
চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিম তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।
১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিনই ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে।
পরে বুধবার (২২ মে) ভারতের এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। এনডিটিভি বলে, ১২ মে কলকাতায় আসার পর নিখোঁজ হওয়া এমপি আনারের খোঁজে তল্লাশি শুরুর পর বুধবার সকালে তার খুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
এরপর গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। তাকে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আটক তিনজন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য আনোয়ারুল আজীম দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের নিশ্চিত করেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে।