বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ‘বিল্ডিং কমোনিটি রেজিলেন্স অ্যান্ড সেলফ রিলাইয়েন্স’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের মৌলিক সেবা ও সুবিধা বাড়ানো হবে। এজন্য খরচ হবে ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই টাকা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ এবং অনুদান হিসেবে নেওয়া হবে।
প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজার জেলায় অনুপ্রবেশ করায় ওই এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এবং স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ওই এলাকার মানুষের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অন্যদিকে, হোস্ট কমিউনিটি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পটি গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু এই প্রকল্প নয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিচ্ছে সরকার। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ওইসব এলাকার অবকাঠামো এবং জীবনমান উন্নয়নে এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে ৭০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। যার মধ্যে ৩১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান ও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার নেওয়া হবে ঋণ হিসেবে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রস্তাবিত ১০টি প্রকল্পের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পগুলো মূলত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক, অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য প্রকল্পগুলো উপস্থাপন করা হবে। এতে সভাপত্বি করবেন একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একনেকে অনুমোদন পেলে এ সপ্তাহেই প্রকল্পগুলো বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় উঠবে। এ কারণে তাড়াহুড়া করে প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য এত বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তাদের মতে, অনুদান দেওয়ার নামে মূলত ওই এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে ঋণ নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হচ্ছে তা রোহিঙ্গা না থাকলে ওই এলাকায় বর্তমানে প্রয়োজন ছিল না। ডলার সংকটের এই সময়ে সরকারের দুর্বলতা বুঝে অনুদানের নামে ঋণ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ এর আগে কখনো রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ নেয়নি সরকার।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার পর এটি হবে কোনো উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে বাংলাদেশের বড় আকারের ঋণ নেওয়ার ঘটনা। এত দিন সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে শুধু বিদেশি অনুদান গ্রহণ করেছে। যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান) আওতায় প্রায় সাত বছর ধরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ।
জানা গেছে, এই ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান দিতে সরাসরি ইআরডি বা পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ না করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে তাড়াহুাড়া করে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করা হচ্ছে। এই অনুদান ও ঋণ ব্যয়ের জন্য নেওয়া প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়নি।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এই ঋণের মাধ্যমে কিছু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে যেগুলো আমাদের পরিকল্পনায়ও ছিল না। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ওই এলাকায় এসব অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো প্ল্যান ছিল না। এখন সংকটের মুহূর্তে অনুদান পেতে সরকার প্রয়োজন না হলেও এই ঋণ নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে আসায় পরিকল্পনা কমিশন বা ইআরডি প্রকল্পের ঋণের বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে পারেনি। তা হলে হয়তো অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো যেত।
জানা গেছে, পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের ৬টি প্রকল্পের বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের পরিমাণ ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ১৯২ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার ও অনুদানের পরিমাণ ১৫৭ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামো বিভাগের চারটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের জন্য রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, বনায়ন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। এ খাতেও ব্যয় হবে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।
প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য হলো কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে আশ্রয় গ্রহণকারী জোর পূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্য স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং দুর্যোগ সহনশীল বিভিন্ন ধরনের মৌলিক ও মানবিক সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জীবন-জীবিকার মান ও সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন। এ ছাড়া প্রকল্পের বর্ণিত উদ্দেশ্য অর্জনের স্বার্থে প্রকল্প এলাকায় উপযোগী অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধাদি নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে সরকারি পরিষেবা প্রদানে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করা হবে।