23 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

রাইসির মৃত্যুতে প্রভাব পড়বে কতটা?

ইরানের ভারজাকানে অতিসম্প্রতি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। হেলিকপ্টারটি বহন করছিল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদোল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালেক রহমাতি এবং পূর্ব আজারবাইজানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলি আলে-হাশেমসহ বেশ কয়েকজন ইরানি উচ্চ-প্রোফাইল কর্মকর্তাকে। হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের এ ঘটনায় অভাবনীয়ভাবে ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু ঘটে। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একসঙ্গে এমন আকস্মিক মৃত্যুতে ঘটনাটি এ অঞ্চলসহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। এ ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটল যখন এ অঞ্চলে আঞ্চলিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্রভাবে বিরাজমান; যার তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী উভয় প্রভাবই অত্যন্ত গভীর।

রাইসি বছরের পর বছর ধরে দেশটির উপপ্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতিসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর এবং তারপর প্রসিকিউটর হিসেবে রাইসির বিচারিক ভূমিকা চিহ্নিত করতে বা বোঝাতে ‘তেহরানের কসাই’—এ শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৯৮৮ সালে হাজার হাজার রাজবন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য দায়ী করা হয় যে প্রসিকিউশন কমিটিকে, রাইসি ছিলেন সেই কমিটির চার সদস্যের অন্যতম একজন সদস্য।

রাইসি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশিষ্ট বনিয়াদ আস্তান কুদস রাজাভির অভিভাবক ও চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের বিশেষজ্ঞ পরিষদের অন্যতম সদস্য।

রাইসির রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয় ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তখন তিনি ইসলামিক রেভল্যুশন ফোর্সের কনজারভেটিভ পপুলার ফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন। যদিও তিনি মধ্যপন্থি ক্ষমতাসীন হাসান রুহানির কাছে সেবার হেরেছিলেন, তবে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তিনি রুহানির উত্তরাধিকারী হন।

আরো পড়ুন  শায়েখ প্লিজ সেজদা থেকে উঠুন, ৪৭ তম বিসিএসের প্রশ্ন ড্রপ করতে হবে

রাইসিকে সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশটির ধর্মীয় নেতাদের সংস্থার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ইরানের রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থায় তার বিশেষ রকমের প্রভাবই তাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রধান প্রধান মূল্যবোধের সঙ্গে ঐকমত্য এবং বিভিন্ন বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই ছিল তার ওপর বিশ্বাসের ভিত্তি; যা তাকে চূড়ান্ত নেতৃত্বের কাতারে আসতে গ্রুমিং গ্রাউন্ড হিসেবে দেখা হয়।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান চরম উত্তেজনার মধ্যে রাইসির মৃত্যু ঘটেছে। গত মাসে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটকে লক্ষ্য করে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ইরানের কুদস ফোর্সের একজন সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের অন্যান্য সাত কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি নিহত হন। ইরান তখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণ করে প্রতিশোধ নেয়, যা সংঘর্ষ ও উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। এরপর ইসরায়েল ইরানের সামরিক স্থাপনায় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ ঘটনাগুলো ছিল আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য বৃহত্তর হুমকিসহ দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের একটি উল্লেখ করার মতো উত্তেজনা।

ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতি আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী উভয় ক্ষেত্রেই চড়া উত্তেজনার কারণ হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত পারমাণবিক অগ্রগতির সাম্প্রতিক উন্নয়ন পরিস্থিতির জটিলতা ও অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতি এরই মধ্যে ভঙ্গুর মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

আরো পড়ুন  শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলার কথা আগেই জানতেন জিয়াউল, জানতেন হাসিনাও!

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর অর্থ হলো বর্তমানে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ মোখবারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা। কিন্তু এ পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয় নয়। এখানে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। গত সোমবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের পদে মোখবারের পদোন্নতিই সেই ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোতে যে খামেনির একছত্র প্রভাব রয়েছে এবং ইরানে এমন সাংবিধানিক বিধানও রয়েছে, যা খামেনির অনুমোদন ছাড়া পরিবর্তন হয় না—সেই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে।

মোখবার ২০২১ সাল থেকে ইরানের সপ্তম প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার এক্সপিডিয়েন্সি ডিজারমেন্ট কাউন্সিলেরও সদস্য। তার কর্মজীবনে রয়েছে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসে একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টের স্পিকার ও বিচার বিভাগের প্রধানের সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করতে হবে এবং সেই কাউন্সিলকে অবশ্যই সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

আলি লারিজানি ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। তিনি ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট পদের একজন সম্ভাব্য ও জোরালো প্রার্থী। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদও ভাবতে পারেন আবারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদোলনাসের হেমাতিও এ পদের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। মোহসেন রেজা ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার-ইন-চিফ এবং সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক সেক্রেটারি সাইদ জলিলিও সম্ভাব্য প্রার্থী। এ কয়েকজন ব্যক্তিই ইরানের সবচেয়ে কট্টরপন্থি রাজনৈতিক শিবিরের প্রতিনিধিত্ব করে।

আরো পড়ুন  নতুন কর্মসূচি ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের

রাইসির মৃত্যু হলেও ইরানের অভ্যন্তরীণ অথবা বিদেশনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, দেশটির চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী খামেনি এবং ইরানে তিনিই শেষ কথা। এ ছাড়া ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য শক্তির অধিকারী। অর্থাৎ এই আইআরজিসির যথেষ্ট শক্তি রয়েছে, যা ইরানের কৌশলগত দিক দৃঢ়তার সঙ্গে চালিয়ে যেতে সমর্থ।

ইরানের প্রভাবশালী নেতা রাইসির মৃত্যু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এ কথা সত্য। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও ইরানের মধ্যে ক্ষমতার বৃহত্তর কাঠামো এখনো রয়েছে অপরিবর্তিত ও শান্ত। এটা সম্ভব হচ্ছে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ও আইআরজিসির সামর্থ্যের কারণে, যারা ইরানের রাষ্ট্রীয় পলিসি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

তবে রাইসির মৃত্যু খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের মধ্যে আরও তীব্র প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির বয়স এখন ৮৫ বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে উত্তরসূরি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। ফলে খামেনির মৃত্যু হলে ইরানের কট্টরপন্থি রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে তার অবস্থান নেওয়ার জন্য এ প্রতিযোগিতা তীব্র হবে, বলাই বাহুল্য। তবে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা কে হবেন—এই প্রতিযোগিতা, কেবল তা নিয়েই নয়; বরং কে হবেন প্রেসিডেন্ট সেটা নিয়েও। সুতরাং, ইরানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই দুটি ভূমিকা বা প্রবণতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে খামেনি-পরবর্তী যুগে। এখন থেকে পরবর্তী কয়েক মাস ইরানি এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী নেতৃত্বে আসতে তৎপর হবেন এবং সেই কারণে দেশটিতে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কূটকৌশল দেখা যেতে পারে।

সর্বশেষ সংবাদ