ভারতে গিয়ে খুন হওয়ার পর ২২ দিন পার হলেও ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহের খোঁজ মেলেনি এখনো। কলকাতার যে অ্যাপার্টমেন্টে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানকার সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে কিছু মাংসের টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেগুলো সংসদ সদস্যের দেহের অংশ কি না, এখনো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক জানাজা কিংবা দাফন সম্ভব হয়নি। আইনি সীমাবদ্ধতায় আসনটি শূন্য ঘোষণা করতে পারেনি সংসদ সচিবালয়। তা সত্ত্বেও আনারের আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে শুরু হয়ে গেছে দৌঁড়ঝাপ। এরই মধ্যে এই আসনটিতে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েকজনের নাম। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা নানা কৌশলে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন। টানা তিনবারের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের অনুপস্থিতিতে তার উত্তরসূরি কে হচ্ছেন, তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি গ্রুপ পরিচালিত হতো আনোয়ারুল আজিম আনারের নেতৃত্বে। আর সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের অনুসারীরা আরেকটি গ্রুপে রয়েছেন। আনারের মৃত্যুর কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন কোনো মেরুকরণ ঘটবে কি না, এখনো তা স্পষ্ট নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাসহ ১৪ জন দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, উপনির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন তৎপরতা শুরু করেছেন। তারা দলীয় কর্মীদের নানাভাবে বার্তা দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সংসদ সদস্য আনারের মরদেহ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য না মেলায় নির্বাচন ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর বলে মনে করছেন অনেকেই। এ কারণে কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন না। তবে শেষ পর্যন্ত উপনির্বাচন হলে প্রার্থী হতে চান বলে জানিয়ে রাখছেন অনেকেই। তারা ফেসবুকে জনকল্যাণমূলক কাজের প্রচার করছেন। কেউ কেউ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
জানা গেছে, উপনির্বাচন হলে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠাণ্ডু দলের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর কালীগঞ্জে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করি। আমাদের হাত দিয়েই কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নেত্রী সব জানেন। উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করব। মনোনয়ন পেতে পারি। মনোনয়ন পেলে এই আসন থেকে জয়ী হব। মৃত্যুর আগে আমি একবার এমপি হতে চাই।’
১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের সহধর্মিণী শামীমা আরা মান্নান ও ছোট ভাই আব্দুর রশিদ খোকন নৌকার টিকিট চাইবেন। শামীম আরা মান্নান বলেন, ‘এমপি আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে তার মৃত্যুর কারণে এ আসনে উপনির্বাচন হলে আমি প্রার্থী হব। আমার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করব।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইসরাইল হোসেন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন নৌকার মনোনয়ন চান। ইসরাইল হোসেন বলেন, ‘স্নেহষ্পদ আনারের নিহত হওয়ার কারণে আসনটি শূন্য হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এখানে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে, তবে স্বতন্ত্র নয়।’
আইয়ুব হোসেন জানান, ‘এমপি আনার আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন চাইব। নেত্রী যদি দেন তাহলে ভোট করব, না দিলে নয়।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ-২ আসনের ভোটার হলেও এই আসনে উপনির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন। সাবেক ছাত্রনেতা কাজী নাসিম আল মোমিন রূপকসহ আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতা দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনও নৌকার মনোনয়ন চাইবেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যু সনদ দেওয়ার আগে উপনির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলে তারপর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল ইসলাম বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। উপনির্বাচনে মনোনয়ন দিলে আমি ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।’
ওই নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী নুর উদ্দীন আহম্মেদ উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে চান না। তিনি বলেন, ‘বর্তমান দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে এমন পরিবেশে আর নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’
কালীগঞ্জ পৌরসভা, উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসন গঠিত। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬২০ জন। এর মধ্যে রয়েছেন পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬, নারী ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ও তৃতীয় লিঙ্গের ৪ জন।
