19 C
Dhaka
Thursday, December 12, 2024

স্বামীর দুর্নীতিতে জেলে গেলেন তিন স্ত্রী, ‌‘দুদকের বিশাল সাফল্য’

দুর্নীতি করলেন স্বামী। সাজা পেলেন তিন স্ত্রী! এমনই ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কুমিল্লার আদালতে তিতাস গ্যাসের পিয়ন জহিরুল ইসলাম জহিরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তিনটি মামলার রায়ের পর অনেকেই বলছেন, দুদকের জালে রাঘববোয়াল ধরা পড়ে না। চুনোপুটি ধরেই নিজেদের অর্জনকে বিরাট বলে ফলাও করে প্রতিষ্ঠানটি।

তিতাস গ্যাসের পিয়ন জহিরুল ইসলাম জহিরের স্ত্রী তিনজন। ভালোবেসে স্ত্রীদের অর্থ সম্পদের কমতি রাখেননি। কিন্তু সম্পদের সেই পাহাড় ঢেকে রাখতে পারেননি। খেয়েছেন দুদকের মামলা। এতে সাজা হয়েছে তিন স্ত্রীর। অথচ জহিরুল সবগুলো মামলার আসামি থাকলেও তার কোনো অপরাধই প্রমাণ করতে পারেনি দুদক। ফলে স্ত্রীরা আটকে গেলেও খালাস পেয়ে যান তিনি!

বেসিক ব্যাংক থেকে টাকার আস্ত একটা ‘পাহাড়’ সরিয়ে ফেলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। টাকার অংকে যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি। তার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক অভিযোপত্র দিলেও এখনও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারও দেশান্তর হন। এমন রাঘবোয়ালদের ছুঁতে পারে না দুদক। এমনকি তিতাসের পিয়ন জহিরুলও পার পেয়ে গেলেন। জেল খাটলেন তার তিন স্ত্রী!

স্ত্রীদের সাজা হলেও জহিরুল কীভাবে পার পেয়ে গেলেন তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন অনেকে। এমনকি দুদকের কুমিল্লা অফিসেও বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা হয়েছে বলে জানান এক কর্মকর্তা। আর এই ঘটনাকে খুবই অস্বাভাবিক বলছেন দুদকের সাবেক কর্মকর্তারা।

জহিরনামা

গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, পিয়ন জহিরুল ইসলাম জহির কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের আবদুল গফুর সর্দারের ছেলে। তার চাকরি শুরু হয় তিতাসে মাস্টার রোলে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৩৩৬ পিস ৪ ইঞ্চি পাইপ চুরির দায়ে জহিরকে শাস্তি দেয়া হয়। পরে রূপগঞ্জে তিতাসের আঞ্চলিক অফিসে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ৫ বছর কাজ করেন। সেখানে থেকেই ‘জহির বীথি এন্টারপ্রাইজ’সহ তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা স্ত্রী ও ভাগিনাদের নামে।

আরো পড়ুন  ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের লাভ না ক্ষতি?

পরে জহির রূপগঞ্জ তিতাসের কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। অভিযোগ আছে, সেখান থেকেই শুরু হয় তার অবৈধ গ্যাসসংযোগ-বাণিজ্য, মিটার টেম্পারিং এবং নানা অপকর্ম। ‘ডেইলি বেসিসে’ থাকাকালে ফাইল চুরিসহ নানা অভিযোগে রূপগঞ্জ তিতাস অফিস থেকে বহিষ্কৃত হন জহির। এরপর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের প্রধান কার্যালয়ে তিতাস গ্যাস ভান্ডার বিভাগের পিয়ন হিসেবে চাকরি নেন। বর্তমানে তিনি সেখানেই কর্মরত।

অভিযোগ রয়েছে, জহির অবৈধ গ্যাস সিন্ডিকেটের হোতা ছিলেন। তিতাস কর্তৃপক্ষ কোনো এলাকায় গিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে এলে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জহির ওই জায়গায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিতেন। অবৈধ গ্যাস সংযোগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি নিজের ও তিন স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন। তার গ্রামের বাড়ি বুড়িচং, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, দামি গাড়ি ও বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে।

কীভাবে পার পেলেন জহিরুল?

২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দুদক কুমিল্লা কার্যালয় থেকে পিয়ন জহিরুল ইসলাম ও তার তিন স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৩টি মামলা করা হয়। প্রায় সাড়ে ৩ বছর পর রোববার (৭ জুলাই) সেই মামলার রায় হয়। মামলার রায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের আলাদা মামলায় জহিরুল ইসলামের তিন স্ত্রী মোসা. সেলিনা আক্তার, মোসা. আকলিমা আক্তার ও মোসা. আছমা আক্তারকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ প্রায় ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত।

প্রথম স্ত্রী সেলিনা আক্তারকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১২ লাখ ১২ হাজার ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড, দ্বিতীয় স্ত্রী আকলিমা আক্তারকে ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৩৪ লাখ ৩ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং তৃতীয় স্ত্রী আসমা আক্তারকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩১ টাকা অর্থদণ্ড দেন কুমিল্লার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বেগম শামসুন্নাহার।

আরো পড়ুন  আতঙ্কে যেসব পুলিশ কর্তারা

রায় ঘোষণার সময় তিন স্ত্রীকে নিয়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন জহিরুল। স্ত্রীদের সঙ্গে প্রতিটি মামলাতেই দ্বিতীয় আসামি হিসেবে নাম ছিল তার। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সব মামলা থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।

এ বিষয়ে দুদক কুমিল্লা সমন্বিত কার্যালয়ের নম্বরে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) দফায় দফায় কল করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ফোন করা হয় সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ, মাসুম আলী ও পাপন কুমার সাহা এবং উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের মোবাইল ফোনে। তারাও ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া দুদক কুমিল্লা সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক, উপসহকারী পরিচালক মো. ইমরান খান ও সিদ্দিকুর রহমান রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো মোবাইল ফোন নম্বর ওয়েবসাইটে দেয়া নেই।

তবে বিকেলের দিকে দুদকের কুমিল্লা অফিসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে তিনটি মামলার এজাহারে জহিরুল ইসলামকে তার তিন স্ত্রীর সাথে আসামি হিসেবে দেখিয়েছিলেন। প্রতিটি মামলার এজাহারে তাকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যথাযথ প্রমাণ করতে না পারায় আদালত জহিরুল ইসলামকে খালাস দেন।

তবে এই ঘটনাকে খুবই অস্বাভাবিক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মো. মইদুল ইসলাম। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, এখানে কয়েকটা বিষয় ঘটতে পারে। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা হয়তো এই বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি যে, স্ত্রীদের নামে যে সম্পদ, সেটা আসলে তিতাসের ওই কর্মচারীর বেনামি সম্পদ। অথবা দুদকের প্রসিকিউটররা আদালতকে সেটি বোঝাতে পারেননি; অথবা আদালত সেটি বুঝতে পারেননি।

আরো পড়ুন  ২০ মিনিট আকাশে উড়ে যাত্রী নামিয়ে দিল বিমান

স্ত্রীদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মো. মইদুল ইসলামের প্রশ্ন, ‘স্ত্রীরা তাহলে এই সম্পদ পেলেন কোথায়? তাদের যদি সেরকম কোনো পেশা থাকতো বা আয় থাকতো তাহলে ভিন্ন কথা। সেটা নাই বলেই তো তাদের সাজা হয়েছে। আসলে তিতাস কর্মকর্তাই স্ত্রীদের নামে এই সম্পদ গড়েছেন তার অবৈধ আয় দিয়ে; কিন্তু দুদক সেটা তুলে ধরতে পারেনি।’

দুদক কুমিল্লা সমন্বিত কার্যালয়েও কানাঘুষা

বিকালের দিকে দুদকের কুমিল্লা অফিসের আরও এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনিও পরিচয় গোপন রাখতে চান। জানান, মামলাটা তিনি ওই কার্যালয়ে যোগ দেয়ার আগের। তাই এই মামলার বিষয়ে তিনি তেমন কিছু জানেন না। তবে, জহিরুলের মামলার ঘটনা নিয়ে অফিসেও অনেকেই আলোচনা করছেন। দুর্নীতি করলেন জহিরুল, তার স্ত্রীরা সাজা পেলেও তিনি খালাস পেলেন কীভাবে? এটা আসলেই একটা অদ্ভুত বিষয়।’

কুমিল্লা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্তারিত রায়ের কপি হাতে পেলে বোঝা যাবে, সে কেন সাজা পায়নি। রায় হাতে পেলে সেটা কমিশনে পাঠানো হবে। কমিশন চাইলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে সময় সংবাদকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সালাউদ্দিন রিগ্যান জানান, যেহেতু জহিরুল অবৈধ সম্পত্তি স্ত্রীদের নামে করে দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত রায় দেন, সেহেতু স্ত্রীদের সম্পত্তির সূত্র ধরে জহিরুলেরও সাজা হওয়া উচিত। তিনি খালাস পাওয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এখানে দুদকের গ্যাপ ছিল। এমনকি তিনি আলাদা ৩টি মামলাতেই দ্বিতীয় আসামি ছিলেন। তাই দুদক চাইলে সেই খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে।

সর্বশেষ সংবাদ