কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় গুলিতে সাইমন ইসলাম আল আমিন (২৩) নামে এক যুবক মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাসার ফেরার সময় রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এ সময় অনেক্ষণ রাস্তায় পড়ে ছিল তার নিথর দেহ, কেউ ভয়ে ধরতে পারেনি। অনেকক্ষণ পরে কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় তাকে।
নিহত আল আমিন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর মধ্যপাড়ার মো. বাবুল ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির মেজো ছেলে। তিনি সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। ওই এলাকার একটি ফ্যাক্টরিতে নতুন কাজ পেয়েছিলেন। তার বাবা গাজীপুরে কাজ করতেন।
আল আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমাদের বাসা সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায়। মসজিদ আমাদের বাসা থেকে সামান্য দূরে। রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। ছেলেটা রাস্তা পার হয়ে জুম্মার নামাজ পড়তে যায়। কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে গুলির শব্দ শুনে বের হই। সামনেই রাস্তার মোড়ে পাম্পের সামনে লোকজন জড়ো হয়ে আছে দেখে চলে আসি। মনের ভেতর কেমন যেন করছিল। অনেকক্ষণ পার হওয়ায় আবার বের হতে গিয়েও না যেয়ে বাসায় ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর একজন কল দিয়ে বলল আল আমিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন আমার মনে হলো, মানুষ আমার ছেলেকে পড়ে যেতে দেখেই দূরে থেকে জড়ো হয়েছিল। অনেকক্ষণ রাস্তায় পড়েছিল আমার ছেলেটা, কেউ ভয়ে ধরতে পারেনি। আমি বাসা থেকে বের হতে হতে আরেকটা কল আসে, হাসপাতাল থেকে করা অচেনা একটা নাম্বার বলছিল, ‘খালাম্মা আল আমিন মারা গেছে।’ এসময় চারদিকে আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি পাখিটার রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে।
আল আমিনের বাবা মো. বাবুল বলেন, ঘটনার পর আমাকে কেউ একজন কল দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। একটু পরে আবার কল করে বলল মারা গেছে। আমি তখন আমার কর্মস্থল গাজীপুরে। আমি বিশ্বাস করিনি। কারণ সকালে আল আমিনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার ছেলেটা আমাকে কত অনুরোধ করে বলেছিল যেন বের না হই। আমিও বের না হওয়ার ওয়াদা করি। কিন্তু আমি বের নাহলেও আমার ছেলেটাকে আর দেখা হলো না। তার মরদেহ নিয়ে বাড়ি আসলাম।
এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলতে থাকেন, আমার ছেলে রাজনীতি করে না। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আর পড়াশোনা করেনি। আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা করছিল। ছেলেটা নামাজে গেছে। তার কী অন্যায় ছিল? কোন দোষে তাকে গুলি করে মারা হল?
বুক চাপড়ে আহাজারি করে আল আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার পাখিকে ২৩ বছর না খেয়ে না পড়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। টাকা পয়সার জন্য বাবুটারে পড়াশোনা করাতে পারিনি। জুলাই মাসের দুই তারিখে কাজে যোগ দেয়, প্রথম বেতন পাওয়ার আগেই মারা গেল ছেলেটা। ইচ্ছে ছিল বড় ভাইয়ের প্রবাসে যাওয়ার ঋণ শেষ করে আবার পড়াশোনা করবে। ভালো চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবে। গত ৫ মাস আগে বিয়ে করেছে। বউটাকে তুলে আনতেও পারেনি। এর আগেই আমার ছেলেটাকে খুন করে দিল তারা।
তিনি আরও বলেন স্থানীয়দের কাছে শুনেছি, বিজিবির গুলিতে মারা গেছে আমার ছেলে। তার পিঠে গুলি লেগে নাভির ওপর দিয়ে বের হয়ে গেছে। রাতে অ্যাম্বুল্যান্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার ভোরে কুমিল্লার লাকসাম থেকে একটি অ্যাম্বুল্যান্স গিয়ে তার লাশ আনে। পরদিন সকাল ১০টায় ময়নাতদন্ত ও পুলিশ রিপোর্ট ছাড়াই তার মরদেহ দাফন করা হয়।
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও নু এমং মারমা মং বলেন, নিহতের মৃত্যুর বিষয়টি জেনেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পরিবারটিকে সহায়তা করা হবে।