‘এক্সট্রা ক্লাস লাগলে বলো’; ‘শাড়ি পরতে পারো? কেউ পরিয়ে দিয়েছে নাকি নিজেই পরেছো? কতক্ষণ লেগেছে পরতে? কুচি দিয়েও পরতে পারো?’; ‘শাড়ি পরে আসো নাই কেন? কত সুন্দর লাগত!’; ‘আমাকে ভালোবাসো?’; ‘তোমার হাসি আমার ভাল লাগে’; ‘তোমার প্রোফাইল পিকচারটা সুন্দর’; ‘তোমার ছেলে বন্ধু আছে নাকি?’ এই কথাগুলো কোনো বন্ধু বা বয়ফ্রেন্ড তার বান্ধবী বা গার্লফ্রেন্ডকে বলছে না। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ তার নারী শিক্ষার্থীদেরকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সময়ে এসব কথা বলেছেন।
শুধু তাই নয়, ক্লাসে পর্দা করা নারী শিক্ষার্থীদের মাস্ক বা নিকাব খুলে চেহারা দেখাতে বাধ্য করা, শাড়ি পরা শিক্ষার্থীদের দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, সামনের সারিতে এনে বসানো ও ব্যক্তিগত তথ্য জিজ্ঞেস করা, নারী শিক্ষার্থীদের কল ও বার্তা পাঠিয়ে বিরক্ত করা, দেখা করতে চাওয়া, পরীক্ষা শেষে খাতা নেওয়ার বাহানায় হাত ধরার চেষ্টা করা, ক্লাসে দলীয় স্লোগান দেওয়ানো, নম্বর কম দেওয়ার হুমকি প্রদান এবং ছেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সকল অভিযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ইদানীং অনলাইন ও অফলাইনে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অবিলম্বে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন।
গত ১৮ আগস্ট অধ্যাপক আজাদের বিরুদ্ধে মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের কাছে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তুলে ধরে মৌখিক অভিযোগ জানান ভুক্তভোগী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে অধ্যাপক আজাদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক শিক্ষক কোয়ার্টারে তার বাসার সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, আজ (রবিবার) বিভাগীয় চেয়ারম্যান বরাবর শিক্ষার্থীদের লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিভাগটির অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী অধ্যাপক আজাদের বিভিন্ন অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কালবেলার কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী অভিযোগ জানিয়ে বলেন, আজাদ স্যার ক্লাসে পর্দা করা মেয়েদের মাস্ক বা নিকাব খুলে চেহারা দেখাতে বাধ্য করেন। একজন মেয়েকে পরপর দুইদিন মাস্ক খুলে চেহারা দেখাতে বাধ্য করেছেন। কোন মেয়েকে মনে ধরলে তাকে ডেকে সামনে এসে বসার জন্য বলেন। লোলুপ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এক মেয়েকে এক্সাম হলে পেলেই পাশের বারান্দায় যেয়ে কুনজরে তাকিয়ে থাকতেন। পরীক্ষার সময় এক মেয়ের ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এক্সট্রা ক্লাস লাগলে বলো।’ অনেক মেয়েকে ফোন কলে বা মেসেঞ্জারে কল দিয়ে বিরক্ত করতেন, কল দিয়ে সরাসরি দেখাও করতে বলতেন। আওয়ামী লীগের আর ওনার চাটুকারিতা করলে পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দিতেন।
তিনি বলেন, ডিপার্টমেন্টের কিছু শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলো তখন এই দালাল নীল দলের সমাবেশে গিয়ে খুনিদের সমর্থন করেছে। চলমান ঘটনার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সাফাই গেয়েছে। এ ছাড়া আমরা শুনেছি, মুহসিন হলের হাউজ টিউটর থাকাকালে হলের ক্যান্টিন বয়দের দিয়ে নিজের বাসার বাজার করিয়ে নিতেন তিনি। শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিনের খাবারের মান নিয়ে কোন অভিযোগ করলেই তিনি আগ বাড়িয়ে তা তদন্তের দায়িত্ব নিতেন। পরে ক্যান্টিন মালিকের পক্ষেই কথা বলতেন।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগটির এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আজাদ স্যার সবসময় মেয়েদের সাথে ইনফরমাল কথা বলতে পছন্দ করতেন। প্রেজেন্টেশনের সময় উনি আমাকে বলেছেন যে, ‘শাড়ি পরতে পারো? কেউ পরিয়ে দিয়েছে নাকি নিজে পড়েছো? সুন্দর লাগছে তোমাকে!’ তিনি ইনবক্সে মেসেজ-কল দিতে চাইতেন। অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলতেন যা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। পরীক্ষার হলেও তিনি বিরক্ত করতেন যেটা কোনোভাবেই শিক্ষকসুলভ ব্যবহার হতে পারেনা। দেখাও করতে চাইতেন তিনি।
আরেকজন বলেন, আজাদ স্যার খুব বাজে নজরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিশেষ করে শাড়ি পরা মেয়েদের দিকে। এটার ভুক্তভোগী আমি নিজেই। আমাকে শাড়ি কে পরিয়ে দিয়েছে সেটি জিজ্ঞেস করেছেন। পরীক্ষা শেষে খাতা নেওয়ার বাহানায় তিনি আমার হাত ধরার চেষ্টা করছেন।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন যে, ‘তোমার ছেলে বন্ধু আছে নাকি?’ উনি আমাদের মেয়েদের পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করে দেখেন। শাড়ি পরলে উনি বলতেন, ‘শাড়ি কে পরিয়ে দিয়েছে? নিজেই পরতে পারো? কতক্ষণ লেগেছে পরতে? কুচি দিয়েও পরতে পারো?’ আর কেউ কোনোকিছুর প্রতিবাদ করলে তিনি আমাদেরকে ফেইল করানোর এবং ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিতেন।
আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ১ম বর্ষে থাকতে তিনি শুধু আমাকে ও অন্যান্য মেয়েদের মাস্ক খুলতে বলতেন, চেহারা দেখতে চাইতেন এবং ওনার চাহুনীও খুব অস্বাভাবিক ছিল। তবে তাকে আমি তেমন সুযোগ দিতাম না। তিনি আমাকে একদিন হোয়াটসঅ্যাপে তার ফেসবুক আইডির লিংক পাঠিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠাতে বলেন। রিকোয়েস্ট না পাঠিয়ে এড়িয়ে গেলেও তিনি নিজেই আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠান এবং আমি সেটি এক্সেপ্ট না করে তাকে ব্লক দিয়ে দেই। এর জেরে একদিন আমাকে ক্লাসে সামনে ডেকে বললেন, ‘তোমার আচরণ এমন কেন? তোমার ফ্যামিলি খুব কনজারভেটিভ নাকি? ম্যাসেজের কোনো উত্তর দাও না। এরকম এক্টিভিটি কোনো স্টুডেন্টের হতে পারে না। দেখে মনে হয় তুমি আমাকে ইগনোর করো।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, একদিন ক্লাসে প্রেজেন্টেশনের সময় শুরুতেই আমার একটি ছবি প্রথম স্লাইডে ছিল ভূমিকার অংশ হিসেবে। কয়েক সেকেন্ডের মত ছবিটি শো করার পর অন্য স্লাইডে যাওয়ার পরপরই তিনি বলেন, ‘দেখি আবার ছবিটা। কি সুন্দর!’
আরও এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের প্রেজেন্টেশনের দিন আমি একদম লাস্ট বেঞ্চে বসেছিলাম। তিনি আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন সবার সামনে। আমি যাওয়ার পর আমি কেমন আছি, কোন টপিকে প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি কথার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে ভালোবাসো?’ এ কথা শুনে আমি ভরকে গেলাম। ইতস্ততভাবে কি বলব না বুঝে বললাম, ‘জি স্যার।’ এরপর তিনি বললেন, ‘না, তোমরা তো আমাকে ভয় পাও, আমাকে তো ভালোবাসো না।’ এমন কথার এক পর্যায়ে তিনি আবার বললেন, ‘তোমার হাসি আমার ভালো লাগে।’ এরপর এসব কথাবার্তা বলে আবার আমাকে পিছনে পাঠিয়ে দিলেন।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, পরীক্ষার হলে ছেলেদের সাথে বিভিন্নভাবে অন্যায় করতেন। তাদের ওয়াশরুমে যেতে দিতো না, অকথ্য ভাষায় কথাবার্তা এবং এক ধরনের মানসিক টর্চার করতো। মেয়েদের টেবিলের উপর বসে গল্প করত পরীক্ষা চলাকালীন। পরীক্ষার হলে মেয়েদের খাতা নিতো না, কিন্তু ছেলদের খাতা নেওয়া, সিট্ চেঞ্জ, নাম্বার কমানোসহ বিভিন্ন কার্যকলাপ করতেন সবার সামনে। এছাড়া ক্লাসের কয়েকজন বিশেষ শিক্ষার্থীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গ্রুপের স্ক্রিনশট সংগ্রহ করে ক্লাসে এবং ভাইভা বোর্ডে বিভিন্নভাবে হেনস্তাও করছেন তিনি।
আরেক ভুক্তভোগী জানান, প্রথম সেমিস্টারে স্যার আমাদের সবাইকে হলরুমে খাতা দেখাতে নিয়েছিলেন। তখন জানতাম না তার চরিত্র যে এত খারাপ। সবাইকে খাতা দেওয়ার পর যখন সবাই যার যার খাতা দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনই খেয়াল করে দেখলাম আমাদের এক বান্ধবীর স্পর্শকাতর জায়গায় খুবই বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, যা যেকোনো মেয়ের জন্য খুবই অপমানজনক।
বিভাগটির শিক্ষার্থী নিলয় (ছদ্মনাম) বলেন, আজাদ স্যার প্রেজেন্টেশনের সময় মেয়েদের কাছ থেকে শাড়ি পড়ার বর্ণনা শুনতেন, এছাড়া ক্লাসে সে মেয়েদের দাড় করিয়ে মাস্ক খোলাতেন এবং মুখ দেখতেন। তিনি প্রতিদিনই এই কাজ করতেন। আর ছেলেদেরকে তিনি সবসময় অপমানের উপর রাখতেন। আমি চাইনা আমার কোনো জুনিয়র বোন এমন পশুরূপী কারো দ্বারা লাঞ্ছিত হোক। তিনি ক্লাসে আওয়ামী লীগের স্লোগানও দিতে বাধ্য করেছেন এবং বরাবর ছাত্রলীগ করা ছাত্রদেরকে বিভিন্নভাবে সুবিধা দেন।
আরেক ছেলে শিক্ষার্থী বলেন, আজাদ স্যার ডিপার্টমেন্টে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব রাখেন এবং তার মনমতো সবকিছু করেন। তিনি আমাদের ইচ্ছামত অপমান করেন এবং আমাদের নম্বর কম দেওয়ার ভয় দেখান। মেয়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দয়ালু মনোভাব দেখালেও ছেলেদের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ বিপরীত। তার কর্মকাণ্ডে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের সবগুলো ব্যাচ অতিষ্ঠ। তিনি মেয়েদেরকে বলতেন, ‘শাড়ি পরে আসো নাই কেন? শাড়ি পরলে কত সুন্দর লাগত’, ‘তোমার প্রোফাইল পিকচারটা সুন্দর’। পরীক্ষার হলে তিনি কোনো ছেলেকে ওয়াশরুমে যেতে দেননা, কিন্তু মেয়েদেরকে ঠিকই যেতে দেন।
বিভাগ সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৬ সালে ড. আবুল কালাম আজাদকে নারী ঘটিত বিষয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে যোগদান করেন।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদকে গতকাল ও আজ মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এবিএম শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এসকল অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি আমাদের বিভাগে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে। যখন তারা এগুলো জানায় তখন কয়েকজন শিক্ষক ও আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা তাদেরকে বলেছি, তোমরা লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তা একাডেমিক কমিটিতে উত্থাপন করতে পারবো। তখন আলোচনা ও সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে যাওয়া হবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে। আমাদের দায়িত্ব হল, বিভাগের সকল শিক্ষককে নিয়ে বিষয়টি ভালভাবে দেখে, বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো।