একটি ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপ চাদর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন মাথায় হেলমেট ও ভেস্ট পরা কিছু পুলিশ সদস্য। সেই স্তূপের ওপর আরও মরদেহ রেখে সেগুলোও রাস্তার পাশে থাকা পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন ওই পুলিশ সদস্যরা। তবুও নিথর দেহগুলোর ঝুলে পড়া সারি সারি হাত দেখা যাচ্ছে।
এক মিনিট আঠাশ সেকেন্ডের এ ভিডিওটি গত পাঁচই অগাস্ট সাভারের আশুলিয়ায় ধারন করা। এই ভিডিও সম্পর্কে আর কী জানা যাচ্ছে? যেসব মৃতদেহ স্তূপ করে রাখা হয়েছিল, তাদের পরিচয় সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে? কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক কত জন মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন? নিখোঁজদের বিষয়ে আদৌ কোন তালিকা হয়েছে কিনা?
ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানের ওপর ছয় সাতজনের মরদেহ স্তুপ করে নীল চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা।
সেই দেহগুলোর ওপর আরেকজনের সহায়তায় আরেকটি মরদেহ তুলছিলেন পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরিহিত একজন। প্রথমবারের দেহটি তোলা না গেলে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তা তোলা হয়।
নীল চাদর সরে যাওয়ার পর দেখা যায় নীল গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তির মাথা ভ্যানের বাইরে, তার মুখ রক্তমাখা। আরেক জনের হলুদ–সবুজ জামার হাতার অংশ দেখা যাচ্ছে। দুইজনের হাত ভ্যানের বাহিরে। পরে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় মরদেহগুলো।
ভ্যানের মরদেহগুলো থেকে রক্ত চুঁইয়ে নিচের রাস্তায় পড়ে রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে ভিডিওটিতে। ভ্যানের আশেপাশে আরো কয়েক জনকে হাঁটতে দেখা যায়। একজনের হাতে রাইফেল, একজনের হাতে হেলমেট, পরনে পুলিশের ভেস্ট। ভ্যানটির বাম পাশে এ সময় পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরা আরো বেশ কয়েক জনকে দেখা যায় যাদের হাতে রাইফেল ছিল। পেছনে বালুর বস্তা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পেছনের দেয়ালে একটি পোস্টার দেখা যায়। ভিডিওর ঘটনা পাঁচই অগাস্ট আশুলিয়া থানার সামনের রাস্তার।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের গলিতে থানা ভবনের সামনের ভিডিও এটি। এ এলাকা পশ্চিম পাড়া হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। কাছেই আশুলিয়া প্রেস ক্লাব।
ভ্যানে থাকা যে হাতটিতে হলুদ গেঞ্জির অংশ দেখা যাচ্ছে, সেটি আবুল হোসেনের বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী লাকী আক্তার। পশ্চিম পাড়ায় থাকেন বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, ‘গত পাঁচই অগাস্ট দুপুরে উনি লুঙ্গি আর হলুদ জার্সি পরে ঘর থেকে বের হয়ে যান। পরশু দিন রাতে ভিডিওটা ফেসবুকে দেখি। এতো বছর সংসার করি, আমি জার্সি দেইখাই বুঝছি উনি, লুঙ্গিও দেখা গেছে। এতো বছরের সংসারে একটা মানুষের হাত দেইখা বুঝমু না? উনার সেন্ডেলে ময়লা ছিল, ভিডিওতে এটাও হাল্কা দেখা গেছে। ভিডিও দেইখা আমার শাশুড়িও কুমিল্লা থেকে চইলা আসছে। ওইদিন বের হয়ে যাওয়ার পর আর দিনমজুর স্বামীর কোন খোঁজ পান নি। নিখোঁজের ঘটনায় আমি থানায় জিডি করেছি। জিডিতেও স্বামীর পরনে জার্সি, লুঙ্গি ছিল বলে উল্লেখ করেছি। একইসাথে সেন্ডেলের কথাও লিখেছি।
কি ঘটেছিল সেদিন?
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, পাঁচই অগাস্টের দিন আন্দোলনকারীরা থানার সামনে অবস্থান নেয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি করে। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়ে।
সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকা স্থানীয় একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটা আশুলিয়ার থানার একদম পাশেই। পুলিশ যখন গুলি করে তখন বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এখানে সেখানে লাশগুলো পড়ে থাকে। এ অংশটুকু আমার নিজে চোখে দেখা।’
তিনি জানান, এক পর্যায়ে আশেপাশে পড়ে থাকা ছয় জনের মরদেহ পুলিশ একটা ভ্যানের মধ্যে উঠায় যেটার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। থানার সামনে দোতলা ভবনের জানালা দিয়ে একজন এই ভিডিও ধারণ করেন। তবে, এই মরদেহগুলো কিভাবে পুলিশের গাড়িতে গেলো সেটা জানা যায় নি। অনেকেই ধারণা করছে পুলিশই অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের গাড়িতে মরদেহগুলো রেখেছিল।
তিনি বলেন, ‘যখন আন্দোলনকারীরা থানায় হামলা চালায়, থানার সামনে আশেপাশে যত গাড়ি ছিল সবগুলোতেই আগুন ধরায়ে দিছিলো। তেমনই একটা পুলিশের গাড়িতে ছিল লাশগুলো। ওইগুলাও কিন্তু আগুনে পুড়ে যায়, একেবারেই ছয়টাই।’
চার জনের পরিচয় নিশ্চিত
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, চার জনের কাছে পরিচয়পত্র থাকায় স্বজনরা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। পরে মরদেহগুলো তাদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুই জনের পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় তাদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নিহতদের একজন গাজীপুরের একটি কলেজের শিক্ষার্থী তানজিল মাহমুদ সুজয়। তার পকেটে থাকা মানিব্যাগে পরিচয়পত্র দেখে স্বজনরা তাকে চিহ্নিত করেছে।
নিহত সুজয়ের ভাই মো. আল আমিন সরকার বলেন, ‘সনাক্তকরণের জন্য পোড়া লাশগুলো থেকে একটা একটা করে খোলা হয়েছিল। অনেকের আত্মীয় স্বজনরা ছিল, সর্বশেষ লাশটা সুজয়ের ছিল। সাথে ওর মানিব্যাগ, আইডি কার্ড ছিল। ছয়ই অগাস্ট সন্ধ্যায় লাশ হস্তান্তর করা হয়।’
এদিকে আগুন দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারী দুই পক্ষই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে।
তবে, পুলিশই পিকআপ গাড়িতে আগুন দিয়েছে এ রকম কোন এভিডেন্স পাওয়া যায় নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ। কিছু কিছু ছবি যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেটা কোন জায়গার তা বোঝা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, অনেকেই এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানানোয় প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেলে ‘একটু সাইলেন্টলি সেটা নিয়ে কাজটা আগাতে হবে’ নতুবা সবাই ‘হাইড’হয়ে যাবে।
ভিডিওর পুলিশ সদস্য কারা?
পুলিশের ভেস্ট ও হেলমেট পরিহিত যে ব্যক্তি বা যারা মরদেহ তুলছিলেন ভ্যানে এবং আশেপাশে যারা ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিন জনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা তিন জনকে ইতোমধ্যেই আইডেন্টিফাই করেছি। অলরেডি একটা ইনকোয়ারি কমিটি করেছি। তারা অলরেডি ইনকোয়ারি করছে। একটা কমপ্লিট রিপোর্ট আসবে।’
এ ঘটনাকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি জানান, এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবীদের যে রুলস রয়েছে, সেটার আওতায়ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনই নামগুলো প্রকাশ করা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘এ তিন জনই ওই থানার এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন। এই মুহূর্তে নামটা আমরা ডিসক্লোজ করছি না। আরো তদন্তের স্বার্থে। এগুলো সব আইডেন্টিফাইড, সব। ভিজিবল, আর ভিডিও আছে যেহেতু। একইসাথে সাংবাদিকদের দেওয়া তথ্যের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ কাজ করছে।’
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশের এসব সদস্যকে আইনের আওতায় আনার জন্য খোঁজা হচ্ছে। তাই পরিচয় প্রকাশ পেলে তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। যত দ্রুত সম্ভব এটাকে আইডেন্টিফাই করে এগুলার ব্যাপারে আইনগত প্রক্রিয়া আমরা শেষ করবো।’
এদিকে গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, এদের মধ্যে ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ভ্যানে থাকা মরদেহের সংখ্যা একেক ধরনের বলা হয়েছে। তবে, ঢাকার পুলিশ সুপার মুঈদ ছয়টি মরদেহের কথা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, ভ্যানে থাকা ব্যক্তিদের একজনের হাত দেখে এক নারী নিজের স্বামী হিসেবে দাবি করেছেন। তাকে ডাকা হয়েছে। এছাড়া থানায় একটি নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় চার জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
আন্দোলনে নিখোঁজের সংখ্যা কত?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত কত মানুষ নিখোঁজ সে ধরনের কোন তালিকা হয় নি।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহাম্মদ মুঈদ মনে করেন, আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ থানা পুড়িয়ে দেওয়ার পর এখনো নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরে আসাটাই চ্যালেঞ্জ।
তিনি জানান, এরকম হয় নি। আসলে থানাগুলোর যে সিচুয়েশন, আমাদেরতো ফাংশনাল করা এখন চ্যালেঞ্জ। অফিসার, সদস্য সবাইকে বুস্ট আপ করতেছি যেন তারা ফাংশনাল হয়, রেগুলার ওয়ার্কটা করে। সব কাজই হবে সেভাবেই এগোনো হচ্ছে।
এদিকে, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, আন্দোলনের ঘটনায় আহত, নিহতদের তালিকা হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ কত জন রয়েছেন সে বিষয়ে কোন তালিকা হয় নি।
এদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ আন্দোলনে আহত, নিহতদের তালিকা করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ- কমিটি এ তালিকা তৈরিতে সহায়তা করছে।
এ কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাসুদুজ্জামান জানান, আহত ও নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত এগার হাজারের বেশি। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয় নি। সরকারিভাবে এ তালিকাটি করা হচ্ছে। সারা দেশের তথ্য পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। নিখোঁজের বিষয়ে তালিকা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর নিখোঁজ হিসেবে কেউ যদি আমাদের রিচ করেন তাহলে তাদের ইনফরমেশন ক্রসচেক করে দেন সেটা লিস্টেড করতেছি। তবে নিখোঁজ পরিবার যারা যোগাযোগ করেছেন এ রকম পরিবারের সংখ্যা এখনো কম।’
অজ্ঞাতনামাদের বিষয়ে ডিএনএ টেস্ট
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার থেকে ঢাকার রায়ের বাজারে কবর স্থানে জুলাই–আগস্ট দুই মাসে ১১৪ টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। আর একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাকে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটে ধর্মীয় রীতি অনুসারে দাহ করা হয়। এছাড়া, পুলিশের পিকআপ ভ্যানের দুইটি মরদেহ এখনো সনাক্ত হয় নি। এ বিষয়ে ডিএনএ টেস্টের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আমরা একটা প্রক্রিয়ার দিকে আগানোর চেষ্টা করছি। সেটা হলো ডিএনএ টেস্ট। আমাদের গ্রেভইয়ার্ডে যে বডিগুলা আনআইডেন্টিফাইড হয়ে দাফন করা হয় সেগুলা চেষ্টা চালাচ্ছি কবর থেকে তুলে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে তাদেরকে আইডেন্টিফাই করার জন্য। এটা একটু সময় লাগবে।’
তিনি জানান, ‘নিখোঁজ যারা আছেন তাদের বিষয়ে এখন ‘সিস্টেমেটিকেলি ওয়েতে’ আগাতে পারছি না। আহত, নিহতদের পরিবারের যারা আসছেন তাদের নিয়ে কাজ করছি। নিখোঁজের বিষয়টা প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে।’-বিবিসি।