বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, তথ্য সন্ত্রাস ও হলুদ সাংবাদিকতা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।
শনিবার (১২ অক্টোবর) সকালে খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত খুলনা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত বিএফইউজের সদ্য প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। হলুদ সাংবাদিকতার কারণে সাংবাদিকরা তাদের মর্যাদা হারাচ্ছেন। যারা ভালো সাংবাদিকতা করে মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখে, বিপদ এলে পাশে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বড্ড দুর্দিন চলছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা এক অপরিহার্য বিষয়। বলতে গেলে, সাংবাদিকতার প্রাণ বলতে পারেন। বস্তুনিষ্ঠতা হচ্ছে কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষপাতিত্ব না করা। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলা। মোদ্দা কথা বিষয়টা বাড়িয়ে বা কমিয়ে না বলা বা লেখা। আসলে সাংবাদিকতা এমন এক পেশা যেখানে নিজের মন্তব্য লেখার কোনো সুযোগ নেই। আপনি যা জানবেন উপযুক্ত প্রমাণ হাতে নিয়ে তা মানুষকে জানাবেন। একজন সৎ, আদর্শবান সাংবাদিকের লক্ষণ হলো তিনি পক্ষপাতহীন লিখবেন। কিন্তু আমরা সেটা করছি বা করতে পারছি?
পাশাপাশি তিনি বলেন, এটাও সত্য যে, আমাদের দেশের বাস্তবতায় একজন সাংবাদিক কখনোই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার সুযোগ পান না। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা আছে তবুও আপনি স্বাধীন নন। যা সত্য তা আপনি লিখতেও পারেন না বলতেও পারেন না। একজন সাংবাদিককে বহু ঘাত-পরিঘাত পেরিয়ে সাংবাদিকতায় মুনশিয়ানা দেখাতে হয় ।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, মানহানি, হলুদ সাংবাদিকতা, তথ্য সন্ত্রাস, অপপ্রচার, চেক বুক সাংবাদিকতা, ভুল তথ্য, ফরমায়েশি নিউজ, দলকানা স্বভাব, Embedded journalism সাংবাদিক জীবনের কলঙ্ক বয়ে আনতে পারে।
তা ছাড়া তিনি বলেন, মানহানি একটি গর্হিত কাজ। শুধু সাংবাদিক কেন কারো অধিকার নেই কারো মানহানি করা। কোনো সম্মানিত মানুষকে যদি অনুমানবশত অপরাধী বলি সেটা অন্যায়। কোনো সাংবাদিকের উচিত নয় কারো মানহানি করা। কিন্তু সেটি আমরা হরহামেশা করেই যাচ্ছি। হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটা সব চাইতে উচ্চারণ করে সরকারি দল। হলুদ সাংবাদিকতা হলো সংবাদে রঙ দেওয়া অর্থাৎ কল্পনার আশ্রয় নেওয়া, বাড়িয়ে বলা, প্রমাণ হাতে না নিয়ে কথা বলা। আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো এ ভয়ানক কাজটি প্রায়ই করে যাচ্ছে।
চেক বুক সাংবাদিকতা শব্দটার সঙ্গে আমরা খুব একটা পরিচিত নই। সোজা কথায় টাকার বিনিময়ে রিপোর্ট করা। এখন অনেক সাংবাদিক টাকা কামাবার হাতিয়ার হিসেবে এই নোংরা কাজটি করছেন।
এ ছাড়া তিনি বলেন, ভালো সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে হবে। সাংবাদিকরা যেন একটি স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে সাংবাদিক ইউনিয়ন কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হলেও, এটি এখন বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনি ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় সৃষ্টি করছে। সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করতে পারেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার সুরক্ষার জন্য আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করা এবং সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
দেশ এখন ফ্যাসিবাদ মুক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরপরও আমাদের স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য দাবি জানাতে হচ্ছে। সরকারের স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম নীতি থাকলেও তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট অনেকের অনীহা রয়েছে। যে কারণে দেশের গণমাধ্যম এখনো নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার। সরকার বিষয়গুলো জানলেও এসব ক্ষেত্রে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র সুরক্ষা পাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কর্মস্থলেও অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় কিংবা নিরাপত্তা না থাকার কারণে সাংবাদিকরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারেন না। তাই সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন করা জরুরি।
এ ছাড়া তিনি বলেন, সাংবাদিকতা একটি ঝুকিপূর্ণ পেশা। এখানে কাউকে জোর করে নিয়ে আসা যায় না বরং এই ঝুঁকি মেনে নিয়েই আমাদের সাংবাদিকতা করতে হয়।
সাংবাদিকদের পেশার মর্যাদার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই পেশায় যারা জড়িত তাদের দেশের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধের কথা তুলে ধরতে হয়। মনে রাখতে হবে, চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম যদি দুর্বল হয় তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। সুতরাং দেশেকে সুদৃঢ় রাখতে হলে রাষ্ট্রের বাকি তিনটি স্তম্ভের পাশাপাশি চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রকেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন খুলনার সভাপতি মো. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ স্মরণ সভায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা, সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন, জামায়াতে ইসলামীর খুলনা মহানগর আমির অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন হেলাল, বিএফইউজের সহকারী মহাসচিব এহতেশামুল হক শাওন, রফিউল ইসলাম টুটুল, এইচএম আলাউদ্দিন, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আকরামুজ্জামান, সাংবাদিক নেতা রাশিদুল ইসলাম, শেখ দিদারুল আলম, এরশাদ আলী, জিয়াউস শাহদাত, ড্যাব সভাপতি ডা. মোস্তফা কামাল, অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ হোসেন বাচ্চু। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবুল হাসান হিমালয় ও আবদুর রাজ্জাক রানা।