খুলনার কয়রায় কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীতীরে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে গত ৮ মাসে কাটা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার গাছ। চরের এসব গাছ বহু বছর ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ছোট-বড় দুর্যোগে প্রাচীর হিসেবে লোকালয়কে রক্ষা করে আসছে। সেসব গাছ কেটে উপকূলের মানুষকে বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সম্প্রতি উপজেলার হরিহরপুর, বিনাপানি, গাববুনিয়া, বানিয়াখালী, গোলখালী, চরামুখা ও জোড়শিং এলাকায় নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ঘুরে দেখা যায়, বাঁধের পাশের নদীর চর থেকে মাটি কাটার সময় উপড়ে ফেলা হয়েছে চরের গাছ। কাটা গাছ স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো নদীর চরের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এ বাঁধ নির্মাণ করছে। নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারের দাবি, তারা কোনো গাছ কাটছেন না। এলাকার লোকজন এসব গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কিছু লোক করাত দিয়ে উপড়ে ফেলা গাছের কাঠ ছোট ছোট অংশে ভাগ করছেন। চরে পানি জমেছে। পানির মধ্যে কাটা গাছের গোঁড়াগুলো দেখা যাচ্ছে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা স্থানীয়। পাউবোর লোকজন তাদের এসব গাছ কেটে নিতে বলেছেন। এ জায়গা থেকে মাটি নিয়ে বেড়িবাঁধ করা হবে বলে তাদের জানানো হয়েছে।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী প্রায় ৩২ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে এ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া ৩৭ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে বানিয়াখালী এলাকায় ১ হাজার ৩৫০ মিটার বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং নামে খুলনার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরের মার্চ মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
বানিয়াখালী এলাকার বাসিন্দা ইমদাদুল হক বলেন, বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হোক আমরা অবশ্যই চাই। তবে গাছ কেটে নয়। কারণ গাছগুলো কাটলে দ্রুতই বাঁধটি নদীভাঙনের কবলে পড়বে। বাঁধের ভেতর-বাইরে সবখানে যথেষ্ট মাটি কাটার জায়গা ছিল। শ্রমিক দিয়ে সেখান থেকে মাটি আনতে পারত। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে বাঁধের কাছ থেকে মাটি কাটার জায়গা তৈরি করতে কয়েক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। তবে বাঁধ টিকিয়ে রাখতে গাছেরও দরকার।
স্থানীয় লোকজন জানান, কয়রা উপজেলাটি সুন্দরবনসংলগ্ন হওয়ায় নদীর জোয়ারে ভেসে আসা নানা গাছের ফল চরে আটকে গাছগুলো জন্ম নেয়। এতে নদীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষে চরে গড়ে ওঠে সবুজ ঘন বন। কয়েক মাস আগে বাঁধ সংস্কারের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন প্রথমে ওই গাছ কাটা শুরু করেন। পরে এলাকার কিছু মানুষও যোগ দেন। এভাবে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বাসিন্দা শাহারুল ইসলাম বলেন, নদীর তীরের গাছ কেটে ও ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বেড়িবাঁধ মেরামত করা যাবে না। ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটলে গাছ কাটতেই হবে। তাই আমাদের দাবি ভেকু মেশিন নয়, শ্রমিক দিয়ে ঝুড়ি-কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বেড়িবাঁধ মেরামত করা হোক। ঝড়ের সময় চরের বড় গাছগুলো আমাদের ঢাল হিসেবে রক্ষা করে। হঠাৎ বাঁধ নির্মাণের কথা বলে গাছ কাটা হচ্ছে।
বানিয়াখালী গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে শিমুল বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি ওই এলাকার বাঁধের মেরামতের কাজ করছেন। নদীর পাশের চরে মাটি থাকলেও সেখান থেকে মাটি না নিয়ে, বাঁধের পাশ থেকে মাটি নিচ্ছেন। এ জন্য হাজারখানেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে বাধা দিলে ঠিকাদারের লোকজন মামলা করার ভয় দেখান। পরে বাধাহীনভাবে যথেচ্ছ কাজ করেছেন তারা।
গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে শিমুল বিশ্বাস কালবেলাকে জানান, বাঁধের মাটির কাজ শেষ করা হয়েছে। চরের গাছগুলো তারা কাটেননি। স্থানীয় লোকজন কেটে নিয়ে গেছেন।
উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হরষিত কুমার মণ্ডল কালবেলাকে বলেন, কয়েক মাস আগে গ্রামের লোকজনকে পাউবোর লোকজন খবর দেন বাঁধ নির্মাণের জন্য চরের গাছ কেটে ফেলা হবে। এ খবরে গ্রামের অনেকেই গাছ কাটা শুরু করেন। পরে উপজেলা প্রশাসন গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা কেউ মানেননি। গাছ কেটে সব সাবাড় করা হয়েছে।
পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী কালবেলাকে জানান, চরের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে এসব গাছ থাকায় তা লোকজন কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনার সঙ্গে পাউবোর ঠিকাদারেরা জড়িত নন।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা কালবেলাকে বলেন, এসব গাছগাছালি পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি শিকড়ের মাধ্যমে বাঁধের মাটি আঁকড়ে ধরে শক্তি জুগিয়ে আসছিল। এভাবে ৫০ হাজারের মতো গাছ কেটে ফেলা মেনে নেওয়া যায় না। বেড়িবাঁধ যেমন দরকার, তেমনি বাঁধ টিকিয়ে রাখতে গাছও দরকার। উন্নয়নের নামে নির্বিচার গাছ কাটা বন্ধ করা হোক।