জ্বালানি তেল আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক পণ্য। শুধু তেল উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির অনেক দেশ। এমনকি বিশ্ব রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে তেল বাণিজ্য। তাই সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যে এই তেলের বাজার দখলের লড়াই আজও থামেনি। তেলকে ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবেও।
যেসব দেশের কাছে বড় তেলের মজুদ এবং উদপাদন ও রপ্তানির সক্ষমতা রয়েছে তারা তত বেশি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই খ্যাত আরব আমিরাত এমনকি ইরানও।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। গাজা এবং লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যেই তেলআবিবে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে হামলা চালিয়েছে অঞ্চলের অন্যতম বড় পরাশক্তি ইরান। পাল্টা হামলার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলও। তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও তেল অবকাঠামোতে হামলা চালাতে চাইছে। ফলে অনেকেই জানতে আগ্রহী ইরানের তেল উৎপাদন ও জ্বালানি বাণিজ্য নিয়ে।
ইরানের কাছে রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেলের মজুদ। দেশটির মোট অপরিশোধিত তেলের মজুদ ২০৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ২০ হাজার ৮৬০ কোটি ব্যারেল। ইরানের থেকে বেশি মজুদ রয়েছে কেবলমাত্র ভেনেজুয়েলা, সৌদি আরব ও কানাডার কাছে। তবে তেলের উত্তোলন ও রপ্তানিতে অনেক দেশের থেকেই পিছিয়ে ইরান।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান তার তেল উৎপাদন করতে পারছে না। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়া ইরানের তেল উৎপাদনকে দমিয়ে রেখেছে, যা সীমাহীন ক্ষতি করছে দেশটির অর্থনীতির।
তবে ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী আব্বাস আলীআবাদি সম্প্রতি বলেছেন, ইরানে দৈনিক ১১ কোটি লিটার ডিজেল, ১২ কোটি লিটার অকটেন, ৭৩ কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস এবং সাড়ে পাঁচ কোটি লিটার জ্বালানি তেল উৎপাদিত হয়। ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী বলেন, এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, ইরানের উচ্চামাত্রার জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে এবং তেলের মজুদের দিক দিয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
পরিসংখ্যানগুলো বলছে, গত দুই বছরে তেলের উৎপাদন ও রপ্তানি দ্বিগুণ বাড়িয়েছে ইরান। যেখানে তেহরান ২০২২ সালে দৈনিক ৭ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছে সেখানে ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে এসে রপ্তানি করেছে দৈনিক ১৭ লাখ ব্যারেল তেল। দেশটি বলছে, তেলের উৎপাদন আরও বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের তেল রপ্তানি বিগত ছয় বছরের মধ্যে যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ফলে প্রতিবছর দেশটির অর্থনীতিতে অন্তত ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
জ্বালানি বাজারের তথ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ভরটেক্সার হিসাবের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ইরান প্রতিদিন গড়ে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছে। এই তেলের বেশির ভাগই কিনেছে চীন। ২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের পর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল রপ্তানি করেছে ইরান।
মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলছে, ২০২৩ সালে ইরান মোট ৫৩ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার সমান। অর্থাৎ প্রায় বাংলাদেশের এক বছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ ইরান আয় করছে শুধু তেল বিক্রি করে। দৈনিক হিসেবে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।