রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে বাকি খেয়ে লাপাত্তা হয়েছেন ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী। ভুক্তভোগী দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে ও তাদের খাতার তথ্য অনুযায়ী, ছাত্রলীগের এই বাকি টাকার পরিমাণ ১০ লাখের বেশি। ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিতাড়িত হওয়ায় বাকি টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বেশিরভাগ দোকানি। কারও কারও আবার ব্যবসা বন্ধ হওয়ারও উপক্রম হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের দমন-নিপীড়নের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের বহু অভিযোগ এসেছে তাদের বিরুদ্ধে। এসময় তারা ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে বাকি খেয়েছে লাখ লাখ টাকার। গত ১৬ জুলাই ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর আর তাদের ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে ১০ লাখেরও বেশি টাকা বাকি খেয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে বেশিরভাগ টাকা বাকি রয়েছে ক্যাম্পাসের খাবার হোটেলগুলোতে। বাদবাকি চা-সিগারেট ও জুসের দোকানে। ক্যাম্পাসের অন্তত ২৫টি দোকানের বাকির হিসাব থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। ক্যাম্পাসে থাকাকালে বিভিন্ন সময়ে খেয়ে তারা টাকা বাকি রাখত। অনেক দোকানে খেয়ে আবার টাকা না দিয়ে চলে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
ক্যাম্পাসের অধিকাংশ দোকানে বাকির খাতায় নাম আছে রাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান সোহাগ, হবিবুর রহমান হলের সহ-সভাপতি মিনহাজুল ইসলাম ওরফে মিনহাজ, মাদারবখশ হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তামিম খান, ইসমাইল হোসেন, রাব্বিউল হাসান রুপক, মমিনুল ইসলাম মমিন, রাশেদ আলী, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সুমনসহ একাধিক নেতাকর্মীদের।
ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, পরিবহন মার্কেট, মমতাজউদ্দিন একাডেমিক ভবন, শহীদ জিয়াউর রহমান হল, মাদার বখ্শ হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও সৈয়দ আমির আলী হল সংলগ্ন একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাবার হোটেল, জুস বার ও চা-সিগারেটসহ অন্য দোকানগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাকি রয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খাবার হোটেলে বাকি আছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এছাড়া জুসের দোকানে প্রায় দুই লাখ টাকা, চা-সিগারেটের দোকানেও দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বাকি খেয়েছেন তারা। খাতা দেখলে আরও বেশি বাকি নিতে চায় বলে অনেক দোকানি বাকির খাতাই রাখতেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি বাকি খেয়েছে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে বাবুর খাবার হোটেলে। সেখানে ছাত্রলীগের বাকির পরিমাণ ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর আগে ২০২২ সালে একবার বাকি টাকা ফেরত না পেয়ে হোটেল বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
ছাত্রলীগের বাকির বিষয়ে হোটেল মালিক মানিক হোসেন বাবু কালবেলাকে বলেন, ছাত্রলীগের অনেক ছেলে বাকি খেয়ে টাকা দিত না। টাকা চাইলে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিত। সবচেয়ে বেশি বাকি খেয়েছে জিয়া হলের সভাপতি রাশেদ এবং সাধারণ সম্পাদক রাকিব। একজনের কাছে ৭৩ হাজার, আরেকজনের কাছে ৭২ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। এছাড়াও মিনহাজ, ইসমাইল, সুমনের কাছে অনেক টাকা পাওনা আছে। এদের অনেককেই কল দিয়েছি। বেশিরভাগের মোবাইল বন্ধ। এই টাকা ফেরত পাব কি না তা নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় আছি।
টুকিটাকি চত্বরের সবুজ স্টোর নামের খাবারের দোকানি নূর ইসলাম সবুজ বলেন, ‘১৯৯৩ সাল থেকে ক্যাম্পাসে আমি খাবারের দোকান করছি। আগেকার নেতারা খেয়ে কিছু টাকা দিত আর কিছু দিত না। তবে ছাত্রলীগের এই কমিটির আগের কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার সময় থেকে এ রেওয়াজটা পাল্টে যায়। খেয়ে তারা একেবারেই টাকা দিত না। এই কমিটির সভাপতি বাবু আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। আমি টাকা না দেওয়ার পর থেকে বাবু আর তার ছেলেপেলেরা খেয়ে আর কোনো দিন টাকা দেয়নি। প্রথমে এগুলো বাকির খাতায় লিখে রাখতাম, পরে রাগ করে খাতা ফেলে দিয়েছি। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, ব্যবসা তো পরের কথা কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি।’
মমতাজ উদ্দিন একাডেমিক ভবনের সামনে সজল জুস কর্নারের মালিক মো. সজল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গালিব তার ছেলেপেলে নিয়ে গিয়ে আমার কাছে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জুস খেত। কোনোদিন দুশ, পাঁচশ, আবার হাজার টাকা বিল হতো। এছাড়া গালিবের জন্মদিনে ১৫ হাজার টাকার জুস আমার কাছ থেকে নিয়েছে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সে আমাকে আর কোনো বিল দেয়নি। গালিব ছাড়াও তার ছেলেপেলেরা এসেও প্রতিদিন একশ-দেড়শ টাকা বাকি খেয়ে যেত। স্বল্প পুঁজি নিয়ে আমি ব্যবসা করি। এর মধ্যে যদি এত টাকা বাকি রেখে কেউ লাপাত্তা হয়ে যায় তাহলে আমাদের ব্যবসার অবস্থা কি হয় বুঝতে পারেন আপনারাই।’
ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে ফোন করে টাকা-পয়সা চেয়েছে কি না জানতে চাইলে দোকানিরা বলেন, অধিকাংশের মোবাইলে কল দিলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এই টাকা কোনো দিন ফেরত পাবেন কি না সেটি নিয়েও তারা সন্দিহান। অনেকে আবার যোগাযোগ করতে না পেরে হা-হুতাশ করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাসিক হলের প্রধান ফটকের পাশে দোকান রয়েছে মাকসুদ হোসেনের। তিনি বলেন, ‘আমারও অনেক টাকা বাকি। অনেক নেতাকেই কল দিয়েছি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি আবার কারও সঙ্গে পারিনি। দু-একজন নেতা অল্প কিছু টাকা পাঠিয়েছেন। তবে বেশিরভাগেরই কোনো খোঁজ-খবর পাচ্ছি না।’
বাকির বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের মুঠোফোনে কল করা হলে তাদের প্রত্যেকের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপেও কলা করা হয়। কিন্তু তারা কেউ ফোন রিসিভ না করায় তাদের বাকি খাওয়ার বিষয়ে তাদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এখানে পড়তে এসে একটা ছেলে বাকি খেয়ে চলে যাবে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। দোকানিদের অভিযোগগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখব। ছাত্রলীগের অনেকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছেন। এছাড়া বাকির তালিকায় যদি বর্তমান কোনো শিক্ষার্থী থাকে তবে সে টাকা পরিশোধ করবে অথবা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’