মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বেশি দামে কয়লা কেনা হচ্ছে। যার বাজারমূল্য ৯১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি। দেশি-বিদেশি কোম্পানি মিলে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম থেকে এ কেন্দ্রের জন্য ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন কয়লা কেনা হবে। ওই কনসোর্টিয়াম থেকে কয়লা কিনতে উন্মুক্ত দরপত্রের কারিগরি শর্তাবলি একাধিকবার পরিবর্তন করে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। সংশ্লিষ্ট সূত্রেও এসব তথ্য জানা গেছে।
সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, বেশি দামে কয়লা কেনার কোনো সুযোগ নেই। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কয়লা কেনা হচ্ছে। আর দরপত্র যাচাই শেষে বোর্ড সিদ্ধান্ত দিয়েছে কয়লা কেনার।
জানা গেছে, গত বছরের ১৫ নভেম্বর সিপিজিসিবিএল মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তিন বছরে ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে (দুই খামবিশিষ্ট)। দরপত্রটি কয়লা ক্রয় সম্পর্কিত হওয়ায় মূল দরপত্রের কারিগরি শর্তের অংশে ‘কয়লা’ আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল। কিন্তু একটি বিশেষ কনসোর্টিয়ামকে বেআইনি সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশে পতিত হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দরপত্রের কারিগরি শর্তের অংশে পরপর চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে ‘কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার’ শর্তটি পরিবর্তন করে ‘কয়লা অথবা লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট, খাদ্যশস্য আমদানির অভিজ্ঞতা’কে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ওই কনসোর্টিয়ামসহ চারটি প্রতিষ্ঠান ওই দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই টেকনিক্যালি নন-রেসপন্সিভ হওয়ায় বাদ দিয়ে ওই কসসোর্টিয়ামকে গত ১ মে টেকনিক্যালি রেসপন্সিভ (যোগ্য) ঘোষণা করা হয়। এর আট দিনের মাথায় গত ৮ মে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ওই কনসেমার্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাবটি উন্মুক্ত করে। এ সময় দেখা যায়, তারা টনপ্রতি কয়লার সরবরাহ মূল্য ১০৮ দশমিক ৮৭ মার্কিন ডলার প্রস্তাব করেছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এ আর্থিক প্রস্তাবটি মূল্যায়ন করে জানায়, ওই দর অনেক বেশি হওয়ায় ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া প্রস্তাবিত দর গ্রহণযোগ্য নয় বলেও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
জানা গেছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিপিজিসিবিএল এ কনসোর্টিয়ামকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) ইস্যু করেনি। এই অবস্থায় ওই কনসোর্টিয়াম গত ১ ও ৮ জুন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি ৫৭(৫) এবং ৫৭(৭) অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করে। সিপিজিসিবিএল বা মন্ত্রণালয় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অভিযোগ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পরে এ কনসোর্টিয়াম পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি ৫৭(১০) অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ প্যানেলে কোনো আপিল বা হাইকোর্টে কোনো রিট মামলাও দায়ের করেনি। এই কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পর তারা কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী দরপত্র বা প্রস্তাব বিবেচনা করার আর কোনো সুযোগ নেই। তারপরও গত ১৭ অক্টোবর সিপিজিসিবিএল সম্পূর্ণই বেআইনিভাবে ওই কনসোর্টিয়ামকে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার জন্য কার্যাদেশ দেয়। এতে টন প্রতি কয়লার দাম হয়েছে ১০৫ দশমিক ৮৭ মার্কিন ডলার। এর ফলে বাজার মূল্যের চেয়ে ৯১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি খরচ করে কয়লা কিনছে।
আরও জানা গেছে, মাতারবাড়িতে সরবরাহের জন্য প্রস্তাবিত কয়লা অবশ্যই আইসিআই-৩ (কয়লা সূচক) গ্রেডের হওয়ার শর্ত ছিল। ইন্দোনেশিয়ান কয়লা সূচক প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১৮ অক্টোবর আইসিআই-৩ গ্রেড কয়লার বাজার মূল্য ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৭৩ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার এবং দরপত্র মুল্যায়ন কমিটির হিসাব অনুযায়ী প্রতি মেট্রিক টন কয়লার পরিবহণ খরচ ১০ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার। এই হিসেবে গত ১৮ অক্টোবর কয়লার মূল্য ছিল টন প্রতি ৮৪ দশমিক ০৫ ডলার। সিপিজিসিবিএল পূর্বের মতো দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে, প্রতি মেট্রিক টন ১০৫ দশমিক ৮৭ ডলারে ক্রয়ের অনুকূলে কার্যাদেশ দেয়। যা প্রতি মেট্রিক টন কয়লার বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে ২১ দশমিক ৮২ ডলার বেশি ধরা হয়েছে। এই হিসেবে ৯১৬ কোটি চল্লিশ লাখ টাকা বেশি ব্যয়ে এই কয়লা কেনা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশি দামে কয়লা কিনে দুনীর্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার সঙ্গে কোল পাওয়ার জেনারেশনের কিছু কর্মকর্তা জড়িত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি কয়লা ক্রয়ের মাধ্যমে সাময়িক চাহিদা পূরণ করার বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে (ধারা ৬৮ এবং বিধি ৭৪)। এখানে দুনীর্তি করার জন্যই নিয়ম ভঙ্গ করে ওই কনসোর্টিয়ামকে তড়িঘড়ি করে বেশি দামে কয়লা সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই কনসোর্টিয়াম থেকে কয়লা কিনলে দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুনীর্তি বন্ধে দ্রুত এই কয়লা ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।