29 C
Dhaka
Friday, June 28, 2024

জালিয়াতিতে ‘নাম্বার ওয়ান’ রুয়েট কর্মকর্তা মুফতি

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগের শর্ত শিথিল করে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ২০১১ সালের ৩০ মে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরি নেন মুফতি মাহমুদ রনি। বর্তমানে তিনি রুয়েটের গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের ‘গায়েবি সৃষ্ট’ অতিরিক্ত পরিচালক। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, প্রতিটি ধাপে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রতারণা আর জালিয়াতির। একাডেমিক বিভিন্ন সনদপত্র, থিসিস জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে সহকারী রেজিস্ট্রার (সপ্তম গ্রেড) পদের জন্য ২৬ অক্টোবর আবেদন করেন মুফতি মাহমুদ। রুয়েটের চাকরির নীতিমালায় এই পদের ন্যূনতম যোগ্যতা সরকারি বা আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনিক বা একাডেমিক কাজে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু মুফতি মাহমুদ সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে প্রবেশের জন্য রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপে ফেলে ওই সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত শিথিল করতে বাধ্য করেন। এরপর তিনি চাকরির আবেদন ফরমে ‘এসএম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড’ নামে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে ৬ বছর ৫ মাস ১১ দিনের (২০০৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ১৩ জুলাই) অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন। অথচ বিধিমালা অনুযায়ী, এসএম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড একটি ঠিকাদারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ওই পদে চাকরির জন্য তার আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। কিন্তু তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে অবৈধভাবে তিনি বাগিয়ে নেন সপ্তম গ্রেডের এই চাকরি। শুধু তাই নয়, ৬ বছর ৫ মাস ১১ দিনের ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ পদে যে সনদ দেখিয়ে তিনি সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে ঢুকেছেন, ওই সময়ের মধ্যে তার আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে (আরএম সলিউশন, আব্দুর রহিম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এবং রেডিয়েন্ট পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং) কাজ করার প্রমাণ মিলেছে।

আরো পড়ুন  মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে হাফেজ নিহত

অবৈধভাবে চাকরি নিয়েই থেমে থাকেননি রুয়েটের এই কর্মকর্তা। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে মুফতি মাহমুদ উপপরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে আবেদন করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও রুয়েটের চাকরি নীতিমালা অনুযায়ী, এই পদে ন্যূনতম যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল গবেষণা সম্প্রসারণ বা প্রশাসনিক কাজে সরকারি বা আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে সহকারী পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) বা সমমানের পদে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। অথচ এই পদের জন্য আবেদনপত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে রুয়েটে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরিরত ৪ বছর ৮ মাসের (৫ বছর হয়নি) অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন। আর এই পদে নিয়োগের জন্য কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণে তিনি আবারও পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া কথিত সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের (এসএম এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড) ভুয়া সনদটিই ব্যবহার করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০তম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি উপপরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে নিয়োগ পান। এ ছাড়া রুয়েটের অর্গানোগ্রামে গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে অতিরিক্ত পরিচালকের কোনো পদের অস্তিত্ব নেই। অথচ তিনি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ‘অস্তিত্বহীন’ এই পদেই বর্তমানে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

নিজের একাডেমিক শিক্ষাতেও মুফতি মাহমুদ আশ্রয় নিয়েছেন জালিয়াতির। ২০১১ সালে তিনি যখন সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে প্রবেশ করেন, তখন তার চাকরির আবেদনে রুয়েটে এমএসসি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) এমবিএ প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেননি। অথচ চাকরি পাওয়ার পর তিনি একই বছরের ১২ জুলাই এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর আবেদন করেন। রুয়েটে চাকরিরত অবস্থায় এমএসসি কোর্স সম্পন্নের জন্য আবেদন করলেও একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে (রুয়েটে এমএসসি ও রাবিতে এমবিএ) অধ্যয়নরত থাকায় রাবিতে এমবিএ কোর্স করার বিষয়টি গোপন রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত না করেই রাবি থেকে এমবিএ পরীক্ষার সনদপত্র পেয়ে যান তিনি। এমবিএ করার বিষয়টি গোপন রাখলেও শেষ পর্যন্ত এমবিএর সদনপত্র চাকরির ব্যক্তিগত নথিতে নথিভুক্ত করতে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন উপাচার্য বরাবর আবেদন করেন মুফতি মাহমুদ। এভাবে তিনি একদিকে রুয়েটের চাকরির বিধি ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন; অন্যদিকে চাকরিরত অবস্থায় একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত থাকায় তিনি শিক্ষা সনদের বিধিও চরমভাবে লঙ্ঘন করেন। এখানেই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির (রোল: ০৮০৪২০২০০১) অংশ হিসেবে যে থিসিস করেছেন, সেখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি ০৭২০৯৯ রোল নম্বরধারী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও ০৭২০৬২ রোল নম্বরধারী কামরুন নাহার নামের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের দুই শিক্ষার্থীর যৌথ থিসিস পেপার নকল করে নিজের পেপারস জমা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আরো পড়ুন  নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে ৫ বাংলাদেশি আহত

অভিযোগের বিষয়ে মুফতি মাহমুদ রনি কালবেলাকে বলেন, ‘নিয়োগের সব শর্ত পূরণ করেই ২০১১ সালে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে প্রশাসন আমাকে চাকরি দেয়। আমার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন নিয়োগ ও পদোন্নতি দিল?’

চাকরিরত অবস্থায় একই সঙ্গে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে অধ্যয়নরত ছিলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রুয়েটে এমএসসি করার জন্য অনুমতি নিয়েছিলাম। রাবিতে এমবিএ সান্ধ্য কোর্স করেছি। কিন্তু সেখানে অনুমতি নেওয়া হয়নি।’ থিসিস জালিয়াতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই দুই শিক্ষার্থী বিএসসির থিসিস করেছে। আর আমি করেছি এমএসসির থিসিস। কিন্তু আমাদের একই শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। থিসিস করার সময় তাদের আমার সঙ্গে কাজ করতে বলেন। সংগত কারণে থিসিসের কিছু বিষয় একই ছিল। এটি কোনো জালিয়াতি বা কপি করার ঘটনা নয়।’

আরো পড়ুন  ৫১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেনি কোন শিক্ষার্থী

রুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সিরাজুল করিম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘১৩ বছর আগের কথা। ওই সময় নিয়োগে কী শর্ত চাওয়া হয়েছিল, সেগুলো তো মনে নেই। আমি ভিসি ছিলাম। এ ছাড়া নিয়োগ বোর্ডের ৬-৮ সদস্য ছিল। চাকরিপ্রার্থীকে পরীক্ষা-ভাইভা ফেস করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট ছিল কি না, আমি মনে করতে পারছি না। অফিসের ফাইল ও রেকর্ডপত্র দেখলে বোঝা যাবে আসলে কী হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়োগে চাপ তো ছিলই। স্থানীয় নেতারা নিয়োগের সময় অনবরত ফোন করতেই থাকেন। এটি সব নিয়োগের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।’

২০১৬ সালে যখন মুফতি মাহমুদ উপপরিচালক পদে নিয়োগ পান, তখন রুয়েটের রেজিস্ট্রার ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ হোসেন। কীভাবে যোগ্যতা ছাড়াই মুফতি মাহমুদ এই পদে চাকরি পেলেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে অনেক আগের বিষয়। ফাইল না দেখে বলতে পারব না।’

রুয়েটের বর্তমান রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘তৎকালীন প্রশাসন তাকে কোন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে চাকরি দিয়েছে, তা আমার জানার কথা নয়। ফাইল দেখতে হবে। আর ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যদি নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই কর্মকর্তা জালিয়াতি করে থাকলে সেই বিষয়ে সিন্ডিকেট কিংবা ফাইলে নোট দিতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চাকরিত অবস্থায় অন্য কোথাও অধ্যয়নরত থাকলে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। আর তিনি থিসিস জালিয়াতি করে থাকলে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। কারও থিসিসের সঙ্গে ৩০ শতাংশের মিল পাওয়া গেলেও সেটি বাতিলযোগ্য।’

সর্বশেষ সংবাদ