ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার জন্য ঘাতকদের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি করেছিলেন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।
সে অনুযায়ী পরের দিন ১২ মে কলকাতা যাওয়ার পরদিনই তাকে হত্যা করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশে গ্রেফতার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানা গেছে, কিলিং মিশনে অংশ নিতে কয়েক দফায় টাকাও নেন হত্যাকারীরা। এদিকে এমপি আনার হত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহের তালিকায় এসেছে বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম। ভারতের যে বাসা থেকে তার রক্তমাখা কাপড় উদ্ধার করা হয়, সেটিও ভাড়া নেয়া হয় আক্তারুজ্জামান শাহীনের নামে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড এবং তাতে শাহীন জড়িত বলে সন্দেহ আনারের অন্য বন্ধুদেরও। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে দুই দেশের গোয়েন্দারা।
গত কয়েকদিন আলোচনায় ছিলো ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া এমপি আনারের নিখোঁজ রহস্য। নানা জল্পনার পর বুধবার (২২ মে) কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় খুন হয়েছেন এমপি আনার। মরদেহ উদ্ধার না হলেও নিউটাউনের সাঞ্জিভা গার্ডেন্স আবাসনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট থেকে মেলে রক্তমাখা জামাকাপড়। প্রতিবেশি দেশের এমপির খুনের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে ভারতীয় পুলিশ। দেশটির গোয়েন্দাদের দাবি, এমপি আনারকে হত্যার পর ছিন্নভিন্ন দেহ তিনটি ট্রলিব্যাগে করে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।
৫৬ বছর বয়সী আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় গিয়ে পূর্বপরিচিত গোপাল বিশ্বাস নামের একজনের বাসায় উঠেছিলেন। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার জানান, আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় খুন হয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশিরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
জানা যায়, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশে সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজি নামে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন নামে ওই বন্ধুর নাম এসেছে। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই।
এমপি আনারের হত্যার নেপথ্যে কী রাজনৈতিক বিরোধ নাকি অন্যকিছু-রাত পর্যন্ত চলে এমন তরজা। তবে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীন। যিনি আনারের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাকে সন্দেহ করছেন আরেক বন্ধু ও শ্রমিক নেতা গোলাম রসুলও।
এদিকে ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ জানায়, ১৩ মে দুপুরে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বেরিয়ে কলকাতার নিউ টাউনের সাঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে যান। সেখানেই হত্যা করা হয় তাকে। তার নিখোঁজের ঘটনায় ১৮মে কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস। নিখোঁজের তদন্ত করতে গিয়ে কলকাতার পুলিশ তথ্য পায়, ওই ফ্ল্যাটে সৈয়দ আমানুল্লাহ ও শিলাস্তি রহমান নামের দুই ব্যক্তিও ছিলেন। এ তথ্যের সূত্র ধরে এই দুজনকে গ্রেফরতার করে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ফয়সাল আলী ওরফে সাজি নামে আরও এক ব্যক্তিকে গ্রেফরতার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আমানুল্লাহ। তার গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে। তিনি একসময় চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানুল্লাহ সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের আরেক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন তিনি।
তবে চরমপন্থীদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র বলছে, আমানুল্লাহ (আমান) নামে খুলনায় একজন সন্ত্রাসী আছেন, যিনি চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শিমুল ভূঁইয়ার অন্যতম সহযোগী ছিলেন। কিন্তু সাজা খাটার যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে শিমুল ভূঁইয়াই নিজেকে আমানুল্লাহ বলে পরিচয় দেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ পরিচয়দানকারী ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে খুনের জন্য আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গে তার পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি হয়।
পুলিশ জানতে পারে, আক্তারুজ্জামান ও আনোয়ারুল আজিম পুরানো বন্ধু। আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। ঢাকার গুলশানে তার বাসা রয়েছে। তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তার বাসা। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কলকাতার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার সময় আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন; যা ভাড়ার চুক্তিপত্রেও উল্লেখ আছে। আক্তারুজ্জামানকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ খুঁজছে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি গত সোমবার ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, গত ৩০ এপ্রিল কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সাঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ওঠেন আক্তারুজ্জামান শাহীনসহ ৩জন। সেখানে বসে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহীন। পরিকল্পনামাফিক, বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলারকে কলকাতায় নিয়ে যায় চরমপন্থী সেই আমান।
জানা গেছে, ১২ মে চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। আর সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, এমপি আনারকে সাঞ্জিভা গার্ডেন্সের যে ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়, সেখানে তিনি ছাড়াও আরও তিনজন ঢুকেছিলেন। তারমধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এই তিনজনকে আবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বেরিয়েও যেতে দেখা যায়। এছাড়া ওই ফ্ল্যাটে ঢোকার জন্য তড়িঘড়ি করে একটি গাড়িও কয়েকবার আসা-যাওয়া করে। লাল রঙের গাড়িটি জব্দ করেছে দেশটির পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, চাপাতির মুখে আনারকে জিম্মি করে আমান ও তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ। একপর্যায়ে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। এরপর শাহীনের পরামর্শ মতো লাশ গুম করতে এমপি আনারকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। দুটি ট্রলিব্যাগে ভরে তা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় হত্যাকাণ্ডের সহযোগীরা। এছাড়া, অবস্থান শনাক্তে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে যায় আমানের দুই সহযোগী। হত্যাকাণ্ডে এক নারীও জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তবে আমান ও তার সহযোগিরা কত টাকার চুক্তিতে এমপি আনারকে কিলিংশ মিশনে অংশ নিয়েছে তাও খতিয়ে দেখছে দুই দেশের তদন্ত ও গোয়েন্দা সংস্থা।