19 C
Dhaka
Thursday, December 12, 2024

পিলার আছে সেতু নেই, ঠিকাদার বললেন টাকা শেষ

শরীয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা সংযোগ সড়কের কীর্তিনাশা নদীতে ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা সেতুর নির্মাণকাজ দীর্ঘ সময়েও শেষ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও সেখান দিয়ে চলাচলকারীরা। ৭ বছরে দুই দফায় ঠিকাদার পরিবর্তন করেও সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

এ ছাড়াও পুরোনো সেতুটিও ভেঙে ফেলায় গত ছয় মাস ধরে এখান দিয়ে চলাচলকারীদের প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে করে নদী পারাপার হতে হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এখান দিয়ে চলাচল করে। সামনে নদীতে বর্ষার পানি বাড়বে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়বে। যারা ট্রলারে করে নদী পার হতে চান না, তাদের ১৫ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরে সদর উপজেলার প্রেমতলা এলাকা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়।

শুক্রবার (৫ জুলাই) সরেজমিনে নড়িয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন সেতুতে কোনো শ্রমিক কাজ করছেন না। নদীর পূর্ব পাড়ে ভায়াডাক্টের কিছু অংশ নির্মাণ করা হয়েছে, আর পশ্চিম তীর ও নদীতে আটটি পিলার করা হয়েছে। ওই পথে চলাচলকারী লোকজন ট্রলার দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন। ট্রলার দিয়ে নদী পার হতে ১০ মিনিট সময় লাগে। দুটি ট্রলার লাগাতার যাত্রী পারাপার করলেও প্রতিটি ট্রলারেই ভিড় থাকে। সময় বাঁচাতে অসংখ্য মানুষ চাপাচাপি করে উঠছেন। অনেকে ট্রলারে মোটরসাইকেলও তুলছেন।

শরীয়তপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নড়িয়া উপজেলা সদরের পশ্চিম পাশ দিয়ে কীর্তিনাশা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পূর্ব তীরে উপজেলা সদর এবং পশ্চিম তীরে মোক্তারের চর, রাজনগর, নশাসন ও জপসা ইউনিয়ন। এ ছাড়া জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নও রয়েছে। নড়িয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে ওই ইউনিয়নগুলো এবং জাজিরার যোগাযোগের জন্য ১৯৯৭ সালে কীর্তিনাশা নদীর ওপরে ১০৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। ২০১০ সাল থেকে কয়েক বছর সেতুটির আশপাশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদী ভাঙনের কারণে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে সেতুটি ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে এলজিইডি। ওই সময় থেকে সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।

আরো পড়ুন  আ.লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা

২০১৭ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪৫ মিটার সেতু নির্মাণ করার জন্য নাভানা কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও কয়েক মাস পর তা বন্ধ করে দেয়। ২০১৯ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ ফেলে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায়। তখন ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। এরপর ২০২১ সালে পুনরায় দরপত্র দেওয়া হয়। এ দফায় সেতুটির সঙ্গে ভায়াডাক্ট যুক্ত করে এর দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়। ২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ মিটার সেতু ও ২২২ মিটার ভায়াডাক্টের নির্মাণকাজ পায় কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। গত ৯ জুন প্রতিষ্ঠানটির কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে।

আরো পড়ুন  আজ থেকে ছুটবে মেট্রোরেল, টিকিট ক্রায় নিয়ে যা জানা গেল

জাজিরা বিলাসপুরের সারেং কান্দি এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম নড়িয়া বাজারে শাড়ী কাপরের ব্যবসা করেন। তিনি প্রতিদিন বাড়ি থেকে গিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। কামরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পুরোনো সেতু দিয়ে হেটে কিংবা ভ্যানে করে যাতায়াত করতে পারতাম। নতুন সেতু নির্মাণ না করেই পুরোনো সেতুটি ভেঙে ফেলায় আমরা খুবই দুর্ভোগে পড়েছি। প্রতিদিন ট্রলারে নদী পার হতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। আবার এখন বর্ষা আসায় নদীতে স্রোত বেড়েছে খুবই ভয়ে থাকি কখন দুর্ঘটনার শিকার হই।

নড়িয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিকা কালবেলাকে বলেন, প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস ও প্রাইভেট পড়ার জন্য ৩-৪ বার উপজেলা সদরে যাওয়া-আসা করা লাগে। পুরোনো সেতুটি ভেঙে ফেলার পর থেকে ট্রলারে করে পার হতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে নদী পার হওয়ার সময় বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল ড্রেসসহ বই-খাতা ভিজে যায়। এ ছাড়াও ট্রলারে নদী পার হতে অনেক ভয় করে। এখন আবার নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেক স্রোত থাকে। প্রতিদিন খুব ভয়ে ভয়ে ট্রলারে করে নদী পার হতে হচ্ছে।

এ পথ দিয়ে চলাচলকারী একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা, ছাত্র-ছাত্রী ও ব্যবসায়ীরা বলেন, নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে জাজিরা হয়ে ঢাকা যাওয়ার প্রধান সড়ক এটি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ পথে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু কীর্তিনাশা নদী দিয়ে কোনো যানবাহন পারাপার হতে না পারায় নড়িয়ার বিভিন্ন এলাকার মানুষকে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে ঢাকায় যাতায়াত করতে হলে জেলা শহরের প্রেমতলা এলাকা হয়ে অন্তত ১৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে।

আরো পড়ুন  আ.লীগের রাজনীতিতে নেওয়ার আশ্বাসে নারীর সঙ্গে একত্রে বসবাস, অতঃপর...

নতুন সেতুর নির্মাণকাজ চলমান থাকার কারণে পুরোনো সেতুটি গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ভেঙে ফেলতে হয়েছে। পুরোনো সেতু দিয়ে হেঁটে বা মোটরসাইকেলসহ হালকা যানবাহন নিয়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারতেন। এখন ওই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের পারাপার করার জন্য এলজিইডি দুটি ট্রলার দিয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে আরও দুটি ট্রলার দিয়ে যাত্রী ও মোটরসাইকেল পারাপার করা হচ্ছে। এখান দিয়ে প্রতিদিন নড়িয়া উপজেলা সদরের একটি কলেজ, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ট্রলারে নদী পারাপার হচ্ছে।

এ বিষয়ে কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের পক্ষে সেতুটির নির্মাণকাজ করছেন আবদুল ওয়াহাব মাদবর নামের এক ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কালবেলাকে বলেন, হাতে টাকা নাই, খয়রাত করতেছি।

বিষয়টি নিয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রাফেউল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল, তিনি কাজটি শেষ না করে চলে যান।এলজিইডি ঐ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন যে ঠিকাদার কাজ করছেন, তারাও ধীরগতিতে কাজ করছে। তাদের কাজের গতি বাড়াতে একাধিকবার তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বিকল্প একটি ফুট ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। তা আগামী দুইমাসের মধ্যে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ সংবাদ