রাজধানীর শ্যামপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস। রপ্তানির আগে কাঁচা পণ্যের মান যাচাই ও প্যাকিং সেবা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। যথাযথ মান যাচাইয়ের জন্য এখানে আছে একটি ল্যাবরেটরি। ২০২১ সালে এই ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য নেওয়া হয় একটি প্রকল্প। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর অর্থ ছাড় করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। কিন্তু এখানে ঘটেছে উল্টোটা। ভবনের কাজ না করেই তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ১১ কোটি টাকা অনুমোদন করা হলেও অর্থ না থাকায় ঠিকাদারকে দেওয়া হয় ৭ কোটি টাকা। যদিও ওইসব যন্ত্রাংশ এখনো কেনা হয়নি। এ ছাড়া ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারযোগ্য নানারকম যন্ত্রাংশ ২০১৮-১৯ সালের দিকে আমদানি করা হয়েছিল। সেগুলোর প্যাকেট এখনো খোলা হয়নি। অনেকগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা না মেনে ঘুরে এসেছেন প্রকল্প পরিচালক।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় শ্যামপুরের কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে। এই ভবন নির্মাণের ঠিকাদারির কাজ পায় মাল্টিব্রিজ নামের একটি কোম্পানি। ভবনের জন্য মোট ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের চুক্তি থাকলেও এর মধ্যে ১২ কোটি টাকা রয়েছে পূর্ত-সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য। বাকি টাকা বিভিন্ন আসবাব এবং সাজসজ্জার জন্য রাখা হয়েছে।
সরেজমিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনো ভবন নির্মাণের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। চারদিকে টিন দিয়ে ঘিরে রাখা। তবে এই কাজ বাবদ ঠিকাদার প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজশে তুলে নিয়েছে পৌনে ৫ কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাল্টিব্রিজ কোম্পানিকে দুই দফায় দেওয়া হয়েছে এই টাকা।
বাস্তবে পাইলিংয়ের কাজ শেষ না হলেও কাগজে-কলমে ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার কাজও শেষ হয়েছে। বিল পরিশোধের নথিতে দেখা যায়, ফাউন্ডেশন, গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং সেকেন্ড ফ্লোরের কাজের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এমনকি ওই নথিতে ভবনের কোথায় কী কাজ হয়েছে, তারও বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এমনকি ওই নথিতে উল্লেখ রয়েছে স্থায়ী অগ্রিমের টাকা অপেক্ষা ব্যয় বেশি হওয়ার তথ্য।
এসব বিষয়ে মাল্টিব্রিজ কোম্পানির মালিক ইকবাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘দুই তলা পর্যন্ত কমপ্লিট হয়নি। তবে এর মালপত্র এনে রেখেছি। সেটি দেখিয়ে বিল নেওয়া হয়েছে। কাজ চলমান।’
পুরো প্রকল্প যেই ল্যাবরেটরিকে ঘিরে, সেখানেও নেওয়া রয়েছে বিস্তর গরমিল। কারণ উদ্ভিদ সংগনিরোধ ওই ল্যাবরেটরির জন্য এর আগেও প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নানারকম যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি খোলা হয়নি অনেক প্যাকেটও। সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে অনেক যন্ত্রাংশ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ ফাইটোস্যানিটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’-এর আওতায় ২০১৮-১৯ সালের দিকে কেনা হয়েছিল যন্ত্রগুলো। ৫৬ আইটেমের ৭১টি যন্ত্র এরই মধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব যন্ত্র মেরামতের জন্য নেওয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগ। এতে ব্যয় হবে প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা। তবে এসব টাকা দেওয়া হবে ‘উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প’-এর আওতায়।
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব যন্ত্রপাতি অন্তত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক যন্ত্রের সফটওয়্যারের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।
নথিতে দেখা যায়, নতুন করে ‘উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প’-এর আওতায় ফের নতুন ১৮ আইটেমের মেশিন ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্নেল ইন্টারন্যাশনাল। তবে এখন পর্যন্ত এসব মেশিন ল্যাবরেটরিতে না এলেও কাগজে-কলমে বাস্তব দেখিয়ে পাস করা হয়েছে ১১ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে ৭ কোটি টাকা। বাকি টাকা অর্থ থাকা সাপেক্ষে ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হবে বলে বলা হয়। তবে পুরো মালপত্র বুঝে পেয়েছেন মর্মে স্বাক্ষর দেওয়া হয়।
নথিতে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালক এস এম খালিদ সাইফুল্লার পাশাপাশি এসব যন্ত্রাংশ বুঝে পাওয়ার তথ্য জানিয়ে স্বাক্ষর করেছেন প্রকল্পের উপপরিচালক অনন্ত সরকার। এমনকি এসব পণ্য বুঝে পেয়ে ল্যাবরেটরির যন্ত্রাংশের তালিকায়ও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মর্মে স্বাক্ষর করা হয়। তবে বাস্তবে ল্যাবরেটরিতে এসব পণ্যের অস্তিত্ব নেই।
এসব বিষয়ে কার্নেল ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী সামসুদ্দোহা রাসেল কালবেলাকে বলেন, ‘আমি যতটুকু কাজ করেছি, ততটুকুই বিল নিয়েছি। বাকি বিষয়ে জানি না।’
পুরো প্রকল্পে অনিয়ম শুধু এখানেই নয়। এই প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। তা সত্ত্বেও তথ্য গোপন করে চেক রিপাবলিক ঘুরে এসেছেন প্রকল্প পরিচালক এবং উপপরিচালক।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক এস এম খালিদ সাইফুল্লা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা নিয়মের বাইরে কিছু করিনি। ভবন নির্মাণ বাবদ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে এই ঠিকাদার ভালো, তার সিকিউরিটি মানি জমা আছে আমাদের কাছে। সেক্ষেত্রে বেশি টাকা দিলেও নিয়মের ব্যত্যয় হয় না।’
যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ মালপত্র বুঝে পেয়েছি, তার থেকে কম টাকা পরিশোধ করেছি। মাত্র ৭ কোটি টাকা দিয়েছি।’
ল্যাবে নতুন কোনো যন্ত্রাংশ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি কীভাবে ল্যাবের ভেতরের তথ্য জানলেন? এটা তো আপনার জানার কথা নয়।’
বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার আগেই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে আমার যাওয়ার বিষয়টি ঠিক করা ছিল।’