প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে তাদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য ব্যাংকগুলোকে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। রোববার (১৫ জুলাই) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব থাকলে, সেসব হিসাবের লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩ (১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়া হলো।
রোববার বিকেলে গণভবনে চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাসায় পিয়নের কাজ করা লোক ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানালো এত টাকা? জানতে পেরেছি, পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’ এ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এরপরই জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়।
জানা যায়, ৪০০ কোটি টাকার মালিক প্রধানমন্ত্রীর সেই পিয়নের নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীর। তার বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল থানাধীন খিলপাড়া ইউনিয়নে। নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ীতে জাহাঙ্গীরের রয়েছে নিজস্ব বলয়। এখনো এলাকার রাস্তাঘাট ছেয়ে আছে তার বড় বড় বিলবোর্ড ও পোস্টারে।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার পরিচয় নিয়ে কোনো ইঙ্গিত না দেয়া হলেও সরকারপ্রধানের কার্যালয়ের একাধিক সূত্র দাবি করছে, সেই পিয়ন হলেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম। তিনি খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহার খিল গ্রামের কেরানী বাড়ির মৃত রহমত উল্যাহর ছেলে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকার সময় সুধাসদনে কাজ করতেন। সে সময় সুধাসদনে আসা ব্যক্তিদের পানি এগিয়ে দেয়ার কারণে তার নাম হয় পানি জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। তিনি নেতাকর্মীদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর থেকে। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে শেখ হাসিনার খাদ্য বহনকারী হিসেবে ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ তিনি নিজ হাতে রাখতেন বলেও জানা গেছে।
জাহাঙ্গীর আলম দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা পেতে লড়াই করেছেন। তবে নৌকা না পেয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও শেষে প্রত্যাহার করে নেন প্রার্থিতা। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগ মুহূর্তে তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করছেন এমন অভিযোগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনে নিকটস্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতেও বলা হয়।
জানা যায়, জাহাঙ্গীর রাজধানী ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে তার আট তলা একটি বাড়ি রয়েছে। সেটিও তার স্ত্রীর নামে। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তিনি নোয়াখালীতে বিপুল অর্থও খরচ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশাল বহর নিয়ে তিনি সভা-সমাবেশ করতেন। এসব সভা-সমাবেশের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন তিনি। আর যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন।
আরও জানা যায়, ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার। এর বাইরেও ঢাকার মিরপুরে একটি সাত তলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
কোটি কোটি টাকার সম্পদ কামানোর পর রীতিমতো রাজনীতির মাঠে নেমে যান পিয়ন জাহাঙ্গীর। চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। একইসঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য নমিনেশন তুলেছিলেন। পরে নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে তিনি নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। তার বিরুদ্ধে নোয়াখালী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহীমের বিরোধিতা করে তাকে হারানোর পাঁয়তারার অভিযোগও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী পরিচয় দিয়ে এই কাজ করার সময় তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন জাহাঙ্গীর। এমনকি সরকারপ্রধানের কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা গেছে।