23 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহর পদত্যাগের ভাইরাল দাবির ফ্যাক্টচেক

বাংলাদেশে চলমান সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে ফিরে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যের পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় রূপ নেয়। এ সময় বহু হতাহতের খবরও পাওয়া যায়। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে গত ১৯ জুলাই থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে বাংলাদেশ সরকার।

এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহ পদত্যাগ করেছেন দাবি করে একটি তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে।

ফ্যাক্টচেক:

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কথিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহ পদত্যাগ করার দাবিটি সত্য নয় বরং প্রাথমিকভাবে কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই এই দাবিটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভুয়া সূত্র দেখিয়ে এই দাবিটি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এই নামের কোনো লেফটেন্যান্ট কর্নেলের তথ্যও পাওয়া যায়নি।

গুজবের সূত্রপাত:

আলোচ্য দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা ৪১ মিনিটে ‘Bangladeshi Community in Spain’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে পরিচয় গোপন রেখে একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে “লে: ক: আজমতউল্লাহ পদত্যাগ করেছেন সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে। সেনাবাহিনীতে চরম অস্থিরতা। নির্বাহী ক্ষমতা ছাড়া সেনাবাহিনী মাঠে নামছে না।” শীর্ষক একটি পোস্ট প্রচার করা হয়। পোস্টটিতে কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি।

আরো পড়ুন  ‘দুর্গাপূজা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ ভিত্তিহীন’

এর কিছুক্ষণ পর, ১২টা ৫৩ মিনিটে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নোটিশ বোর্ড (National University Notice board)’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে ‘Dipu Khan’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে একই ক্যাপশনে একটি পোস্ট প্রচার করা হয়। পোস্টটির কমেন্টে সূত্র চাওয়া হলে তিনি ‘দ্য মিরোর এশিয়া’ নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেন।

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ওয়েবসাইটটিতে ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় ৭টা ০৬ মিনিটে প্রকাশিত ‘নির্বাহী ক্ষমতা ছাড়া সেনাবাহিনী নামতে রাজি হচ্ছে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রতিবেদনটিতে কথিত এক সূত্রের বরাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারের কারফিউ জারি প্রসঙ্গে বিভিন্ন দাবি করা হয়। তবে, প্রতিবেদনটিতে আজমত উল্লাহ নামের কোনো লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদত্যাগের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া, দ্য মিরোর এশিয়া নামের ওয়েবসাইটটির ডোমেইনটি গত ৩১ মে কেনা হয় এবং এটি গত ১ জুন থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। এই ওয়েবসাইটের বিশ্বাসযোগ্যতা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।

উল্লিখিত পোস্টগুলোর পর কথিত আজমত উল্লাহ নামের সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদত্যাগের দাবি প্রথম আলো নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে প্রচার করা হয়। পরে এই দাবিটি মূলধারার সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর বরাতে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম আলো এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। গণমাধ্যমটির ওয়েবসাইট কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইলগুলোতে এমন কোনো প্রতিবেদনের অস্তিত্ব নেই। এছাড়া, প্রথম আলো নামের উক্ত ফেসবুক গ্রুপটির সাথে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর কোনো সম্পর্ক নেই। উক্ত ফেসবুক গ্রুপের একমাত্র অ্যাডমিন হিসেবে ‘Ma Multimedia’ নামের একটি ফেসবুক পেজ দেখা যায়।

আরো পড়ুন  ‘১৫ আগস্ট’ উপলক্ষে দেশের মানুষের প্রতি যে আহ্বান জানালেন জয়

অর্থাৎ, প্রথম আলোর নামে তৈরি একটি ভুয়া ফেসবুক পেজ থেকে উক্ত দাবিটি প্রচারের ফলে প্রথম আলোকে সূত্র দেখিয়ে একই দাবি প্রচারিত হয়।

একই দাবি সেদিন (২০ জুলাই) ডেইলি স্টারের বরাতেও প্রচার করতে দেখা যায়। তবে ডেইলি স্টার কর্তৃকও এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি।

এরপরে প্রায় প্রতিদিন একই দাবি ফেসবুকে প্রচার হতে দেখা যায়। ৩০ জুলাই এই দাবিটি ‘বিভিন্ন গণমাধ্যম’ এবং যমুনা টিভির সূত্রে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। তবে মূলধারার কোনো গণমাধ্যমেই এই বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি কোনো বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকেও এমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। রিউমর স্ক্যানার টিম এই বিষয়টি জানতে যমুনা টিভি চিফ নিউজ এডিটর তৌহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, গণমাধ্যমটি এমন কোনো খবর প্রকাশ করেনি।

আরো পড়ুন  রাষ্ট্রদূত হলেন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী

রিউমর স্ক্যানার টিম লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহ নামের কোনো ব্যক্তির সন্ধান খুঁজে পায়নি। এছাড়া সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তালিকা যাচাই করেও এই নামে কোনো লেফটেন্যান্ট কর্নেল পাওয়া যায়নি।

মূলত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহ পদত্যাগ করেছেন দাবিতে ২০ জুলাই থেকে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কথিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহর পদত্যাগের দাবিটি মিথ্যা। প্রথমে সূত্রহীনভাবে এই দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। পরে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে এই দাবিটি প্রচারিত হলে একই দাবি প্রথম আলোর সূত্রে প্রচার হতে থাকে। এরপর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নামেও এই দাবিটি প্রচারিত হয়। সর্বশেষ ৩০ জুলাই বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং যমুনা টিভির সূত্রে এই দাবিটি প্রচারিত হয়। তবে বাংলাদেশের মূলধারার কোনো গণমাধ্যমই এমন কোনো খবর প্রচার করেনি। গণমাধ্যমগুলোর নাম ব্যবহার করে ভুয়া সূত্র দেখিয়ে এই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আজমত উল্লাহ নামের কোনো লেফটেন্যান্ট কর্নেলের তথ্যও পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, কথিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজমত উল্লাহ পদত্যাগ করেছেন দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

সূত্র: রিউমার স্ক্যানার।

সর্বশেষ সংবাদ