স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার নিষিদ্ধ হওয়ার ৫০ বছরের বেশি সময় পর ফের নিষিদ্ধ হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময় দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসলেও শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে এসে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো সরকার। বৃহস্পতিবার (০১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার’ নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় দলটির কিছু নেতাকর্মী কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেও দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল বহু বছর।
১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এ সময় আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আই.ডি.এল) নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মের ব্যানারে জামায়াত কাজ শুরু করে। এর তিন বছর পর রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় হতে শুরু করে দলটি। জামায়াতের তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে নয়া দিগন্ত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর বিবিসি বাংলাকে বলেন, নিষিদ্ধ থাকার সময়ে এই দলের নেতারা অনেকে আটক বা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলো। যারা বাইরে ছিলেন তারা আইডিএলে সম্পৃক্ত থেকে সংগঠন গুছিয়েছেন। ১৯৭৯ সালে জামায়াত ইসলামী সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পায়।
বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য কিংবা নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দেয় জামায়াত। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করেন। এ সময় জামায়াতের প্রথম সারির প্রায় সবাইকে আটক করে বিচারের মুখোমুখি করে সরকার। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে চরম কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি, শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন হারিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে। তবে সালাহউদ্দিন বাবর বলেন, এ সময়েও সামাজিক যোগাযোগ এবং অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রেখেছে জামায়াত।
শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তান আমলেও কয়েকবার নিষিদ্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে জামায়াত। ১৯৪৮ সালে ইসলামি সংবিধানের দাবিতে প্রচারণা শুরু করে জামায়াত। তখন পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীকে গ্রেপ্তার করে। ওই বছরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের কার্যক্রম শুরু হয়। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ১৯৫৮ সালে অন্য সব দলের সঙ্গে জামায়াতের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেন তৎকালীন সেনা শাসক আইয়ুব খান।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ফের জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। তখন মওদুদী ও গোলাম আজমসহ অনেককে আটকও করা হয়। তবে একই বছরের শেষ দিকে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। পরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৫১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে চারটি আসন পায় দলটি। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে এবং এর নেতারাও সক্রিয়ভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন।
বাংলাদেশের বিরোধিতা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য ১৯৭৩ সালে যে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার। এদের মধ্যে ছিলেন গোলাম আজমও। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের বাইরে থাকা জামায়াত নেতারা দেশে ফিরতে শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে গোলাম আজম নাগরিকত্ব ফিরে পেতে আবেদন করলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন জামায়াতের এই নেতা।
১৯৭৯ সালে ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। সেখানে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির ঘোষণা করে দলটি। পরের বছর ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের সামনে জামায়াতের প্রথম প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে দলটি। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দশটি আসন পায় জামায়াত। পরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে জামায়াতও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়।
জামায়াতের বড় সাফল্য আসে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে আঠারটি আসন জিতে দলটি। পরে তাদের সমর্থনেই সরকার গঠন করে বিএনপি। তখন থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গণআদালত হয়, সেখানে গোলাম আজমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৯৪ সালে আদালতের রায়ে নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আজম। তখন দল হিসেবে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে জামায়াত।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নিরেপক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে। তখন জামায়াতও আলাদাভাবে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। পরে ১৯৯৯ সালে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট করে জামায়াত, যার নাম হয় চারদলীয় জোট।
২০০০ সালে গোলাম আজম অবসর নিলে দলটির দায়িত্বে আসেন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় গেলে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই জামায়াতের প্রথম সরকারে অংশগ্রহণ। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র দুইটি আসন পায় জামায়াত। ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। এরপর তারা আর কোনো ভোটে অংশ নিতে পারেনি। ওই বছর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় দলের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। এর আগে থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় দলটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা আটক হলে বেশ চাপের মুখে পড়ে দলটি। ওই বছরেই সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট। পরে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে দলটি।
গত বছরেরে নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দলটির আপিল আবেদনটি খারিজ করে দেয়। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ই বহাল থাকে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩১শে জুলাই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো সরকার। এ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হলো দলটি।