ইনসেটে মো. তোফাজ্জেল হোসেন, বাড়িতে ঝুলছে তালা
বরগুনার আমতলী উপজেলায় জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠেছে মো. তোফাজ্জেল হোসেনের বিরুদ্ধে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বয়স ছিল ৮ বছর ১১ মাস ২৫ দিন। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর পাইয়ে দেওয়ার নামে অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এমন সব অভিযোগে এলাকাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হওয়ায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে আমতলী উপজেলা প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তোফাজ্জেল হোসেন বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের কালিবাড়ি নামক এলাকার মো. আয়নুদ্দিন কাজীর ছেলে। তিনি আমতলীর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একেএম সামসুদ্দিন শানুর আত্মীয় (শ্যালক) হওয়ায় তার মাধ্যমেই জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভুক্ত হন। পরে তার ৪৭০ নং গেজেট অনুযায়ী তিনি ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাপ্রাপ্ত হন।
তবে স্থানীয় অনেক মুক্তিযোদ্ধার দাবি- মুক্তিযুদ্ধের সময় তোফাজ্জেলের বয়স কম থাকায় তিনি দেশের কোথাও কোনো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তিনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখিয়েছেন। এছাড়াও তোফাজ্জেল আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরে নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তোফাজ্জেল হোসেন আমতলীর চুনাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ওই বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল আলমের স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যায়নে উল্লেখ করা হয়, তোফাজ্জেল হোসেন ১৯৭৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তার এসএসসি পরীক্ষার ক্রমিক নম্বর ১১৩, নিবন্ধন নম্বর ২৩৪৩৫ এবং শিক্ষাবর্ষ ১৯৭৬-১৯৭৭। তোফাজ্জেল হোসেন ১৯৬২ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন এমন তারিখও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রত্যায়নে। এ হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তোফাজ্জেল হোসেনের বয়স ছিল ৮ বছর ১১ মাস ২৫ দিন। এত কম বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, নাকি ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন এ নিয়ে এলাকায় আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হওয়া প্রকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে আমতলী উপজেলা প্রশাসন।
রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি হবে
তোফাজ্জেল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে স্থানীয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল ইসলাম তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তোফাজ্জেল হোসেন বাংলাদেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তার আত্মীয় সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সামসুদ্দিন শানুর মাধ্যমে জাল কাগজপত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। সাবেক এক উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যোগসাজশে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এ কাজ হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি আমতলী উপজেলার এমন কোনো স্থান নেই যেখানে দুর্নীতি করেনি। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর পাইয়ে দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি কোনো অসহায় মুক্তিযোদ্ধারাও বাদ পড়েনি। তাদের থেকেও সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। আর এসবের মাধ্যমেই তিনি ব্যাপক টাকার মালিক হয়েছেন। ব্যয়বহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন জানাই সকল দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যাতে তোফাজ্জেলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
আমতলী উপজেলার আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় তোফাজ্জেল হোসেনের নাম দেখে আমরা অবাক হয়েছি। যতটুকু জেনেছি তিনি অষ্টম শ্রেণির সনদপত্র বানিয়ে সেখানে বয়স ঠিক করে তা দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তবে তিনি এসএসসি পাস করেছেন। এছাড়া তোফাজ্জেল হোসেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও কর্মরত ছিলেন। তবে তিনি এখন তা অস্বীকার করেন। তিনি যে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন সেখানকার দেওয়া একটি প্রত্যায়নে তার যে বয়স উল্লেখ করা হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ৯ বছরের কম হলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধা হয়েছেন। কিভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তা আমরা জানি না।
অপরদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়ে জানতে সরেজমিনে তোফাজ্জেল হোসেনের বাড়িতে গেলে ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এমনকি তার ফোন নম্বরে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়াও তার আত্মীয় সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একেএম সামসুদ্দিন শানুর মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগ করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে এলাকাজুড়ে তোফাজ্জেল হোসেনকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ায় একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফুল আলম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকদিন আগে আমরা একটি তথ্য পেয়েছি আমতলী উপজেলায় একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। পরে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করতে আমতলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারেক হাসানকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। যদি জালিয়াতির বিষয়ে সত্যতা প্রমাণিত হয় তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।