24 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তাদেরও বড় ভূমিকা

গত দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী সরকারের জমানায় চক্ষুশূল হয়েছিলেন অনেক সাংবাদিক-সমাজকর্মী। জেল-জুলুম, মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে দেশান্তরী হয়েছেন অনেকে। সমাজ-সংসার ফেলে বিদেশ বিভুঁইয়ে কাটানো এসব মানুষ দেশ ছাড়লেও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদে মুখর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের নানা অপরাধ, দুর্নীতি, গুম, খুন ও নিপীড়নের খবর তথ্যসহ তুলে ধরতেন। কেউ কেউ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশে রাখতেন বড় ভূমিকা। নানা কারণে ‘চুপ’ থাকা দেশীয় মিডিয়া যেখানে সরকারের গুণকীর্তন করত, তার বিপরীতে এসব মানুষ সত্য প্রকাশে নিয়েছেন সাহসী তৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত এ সচেতন মানুষদের ভূমিকা গণতন্ত্রকামী মানুষকে দিয়েছিল আন্দোলনের ভিন্ন এক রসদ।

দৈনিক ইত্তেফাক, ইউএনবিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে বেশ উজ্জ্বল মুখ ছিলেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। তিনি ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর জাস্ট নিউজ বিডির প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সরকারের রোষানলে দেশ ছাড়েন এই সাংবাদিক। দেশ ছাড়লেও সরকারের অন্যায়, অনিয়ম আর কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন আন্তর্জাতিক মহলে। বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ায় নিজের লেখনীতে তুলে ধরেন এক স্বৈরাচারী সরকারের গল্প। জাতিসংঘের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংগুলোতে প্রশ্ন করে আন্তর্জাতিক ফোরামে সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। এ ছাড়া জাতিসংঘ, হোয়াইট হাউস এবং ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী সরকারের নানা অনিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরেন তিনি।

জনপ্রিয় বৈশ্বিক গণমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের দুর্নীতি এবং শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অপরাধ সাম্রাজ্যে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এই সাংবাদিক। এরপর একের পর এক সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের নথি ফাঁস করে গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে আস্থার নাম হয়ে ওঠেন জুলকারনাইন। লন্ডনে অবস্থানরত এ সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয়। নির্ভুল তথ্য সরবরাহ, নানা গোপন নথি প্রকাশ করে সরকারকে বিভিন্ন সময়েই প্রশ্নের মুখে ফেলেন এই সাংবাদিক। বর্তমানে বাংলা আউটলুকের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।

আরো পড়ুন  পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্টের ২০ বছরের কারাদণ্ড

সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনীম খলিল। নির্বাসনে থাকা এই সাংবাদিক একের পর এক দুর্নীতি এবং অনিয়মের নিউজ প্রকাশ করে সারাবছরই আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশের। সরকারও নেত্র নিউজ সাইট ব্লক করে রাখে বাংলাদেশে। বিদ্যুৎ সেক্টর, ব্যাংক, পুলিশি হত্যাকাণ্ড, গুমসহ দেশের প্রায় সব অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তাসনীম খলিল এবং নেত্র নিউজ।

ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য। ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক হলেও তিনি সবসময় মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। যার ফলে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি যেন মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি এবং দলবাজির কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি ইউটিউবে তুলে ধরতেন বিশ্লেষণাত্মক মতামত। সাধারণ মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় শিক্ষক বাবার সন্তান পিনাকীর গ্রামের বাড়ি দেশের বগুড়া জেলায়।

টুঁটি চেপে রাখা গণমাধ্যমের নানা অনিয়ম, সুবিধাবাদী সাংবাদিক এবং সরকারের দুর্নীতি, শোষণের নানা চিত্র তুলে ধরে সবসময় আলোচনা ছিলেন লন্ডনে নির্বাসিত সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলাও করেছেন সরকারের সুবিধাভোগীরা। গ্রামের বাড়িতে হামলা, বাবা-মাকে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। এরপরও গত প্রায় অর্ধডজন বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সোচ্চার ছিলেন জাওয়াদ নির্ঝর। স্বৈরাচারী সরকারের নানা অনিয়ম, নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তুলে ধরতেন নানা তথ্য। সোচ্চার ছিলেন পুলিশি হত্যা, গুম-খুন নিয়েও। নানা চাপে দেশীয় গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশ হতো না, সেসব সংবাদ নিজের ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করতেন। এ ছাড়া করাপশন ইন মিডিয়া নামে একটি ফেসবুক পেজে তুলে ধরতেন গণমাধ্যম সংক্রান্ত নানা অনিয়মও।

আরো পড়ুন  অনলাইন অর্ডারের পার্সেল খুলতেই বেরিয়ে এলো বিষধর সাপ (ভিডিও)

বাংলাদেশি সাংবাদিক মনির হায়দার। সরকারের রোষানলে দেশ ছেড়ে আবাস গড়েন মার্কিন মুল্লুকে। তবে সরকারের অন্যায় এবং অনিয়ম নিয়ে সোচ্চার ছিলেন বরাবরই। নিজের ফেসবুক পেজে নিয়মিত

অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উন্মোচনের পাশাপাশি ইউটিউবেও সমালোচনা করতেন সরকারের। স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশি নির্যাতন, গুম, খুনের বিষয়গুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তুলে ধরতেন মনির হায়দার।

যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাভিত্তিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নাগরিক টিভি। এটি পরিচালনা করেন মোস্তাফিজুর রহমান টিটো এবং নাজমুস সাকিব। প্রায় এক দশক ধরে সরকারের অনুগত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি এবং অনিয়ম তুলে ধরে আলোচনায় ছিল এ প্ল্যাটফর্মটি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের শোষণমূলক নীতি, গুম, খুনের বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান টিটো এবং নাজমুস সাকিব।

দেশীয় গণমাধ্যমের আলোচিত মুখ মোস্তফা ফিরোজ। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের হাতেখড়ি মোস্তফা ফিরোজের হাত ধরে। তবে স্বৈরাচারী সরকারের রোষাণলে পড়ে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। দেশে হুমকির মুখে পড়লেই তিনি চলে যেতেন বিদেশে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বসে কাজ করতেন। সেখানে বসে সরকারের নানা অন্যায় আর অনিয়ম নিয়ে নিয়মিত লিখে গেছেন এই সাংবাদিক। ফেসবুক এবং ইউটিউবে নিয়মিত সমালোচনামূলক ভিডিও আপলোড করতেন মোস্তফা ফিরোজ। দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও তুলে ধরতেন আন্তর্জাতিক মহলে।

আরো পড়ুন  বেতন বেশি হলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম, দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যু

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ফাহাম আব্দুস সালাম স্বৈরাচারী সরকারের একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মলিকুলার থেরাপিউটিক্স নিয়ে গবেষণা করে লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে দক্ষতা থাকা ফাহাম আব্দুস সালাম নানা তথ্য এবং যুক্তিনির্ভর সমালোচনা করতেন সরকারের। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় এ বিজ্ঞানী ফেসবুক সরকারের অনিয়ম এবং অনাচার নিয়ে নিয়মিত লিখতেন। এ ছাড়া ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও সরকারের নানা অনিয়মের উপাত্তনির্ভর সমালোচনা করতেন।

ক্ষুরধার যুক্তি এবং নতুন নতুন তথ্য দেওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার। স্বৈরাচারী সরকারের গুম-খুনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কনক সারোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অনেক। এমনকি তার পরিবারকেও এর মূল্য দিতে হয়েছে। এরপরও থেমে যাননি তিনি। সরকারের নানা গোপন তথ্য, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি।

একসময়ের জনপ্রিয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। সরকারের রোষাণলে পড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অনেক মামলাও রয়েছে। তবে বিদেশে অবস্থান করলেও ইলিয়াস হোসেন নানা তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশ করেন নিজের ফেসবুক আইডি এবং ইউটিউব চ্যানেলে। বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে আলোড়ন তোলেন দেশের মিডিয়া পাড়ায়।

টেলিভিশন সাংবাদিকতায় জনপ্রিয় মুখ শাহেদ আলম। সরকারের রোষাণলে পড়ে দেশ ছেড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে বসেও সরকারের নানা অনিয়ম নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। ফেসবুক এবং ইউটিউবে তথ্যনির্ভর সমালোচনা দেশের তরুণদের মধ্যে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

সরকারের কঠোর সমালোচনা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনকে নানা তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে সারা বছরই বেশ আলোচনায় ছিলেন জ্যাকব মিল্টন এবং শফিকুল আলম।

সর্বশেষ সংবাদ