চারপাশে তখন মুহুর্মুহু সাউন্ডগ্রেনেডের শব্দ। তার মধ্যেই হঠাৎ করে এলোপাতাড়ি গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের দুজন লুটিয়ে পড়লেন। তাদের শরীর থেকে অনবরত রক্ত ঝড়ছে। ওদিকে থামছে না পুলিশের গুলিও। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। হামলার তেজ তাতে যেন আরও বাড়ে। কমতে থাকে বেঁচে ফেরার আশাও। কিন্তু দুই সহযোদ্ধাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালাতে মন সায় দেইনি। যদিও কাছে গিয়ে বুঝলাম তারা আর বেঁচে নেই। এর মধ্যেই আমার দিকে চায়না রাইফেল তাক করে গুলি করে পুলিশ। তা বিদ্ধ হয় বাঁ হাতের বাহুতে। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে যায় সেই গুলি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ক্ষণিকের মধ্যেই পুরো শরীর ভিজে যায়। ধীরে ধীরে অচেতন হতে থাকি। ভেবেছিলাম পাশের দুজনের মতোই পরিণতির দিকে পা বাড়াচ্ছি। কালেমা পড়তে পড়তে জীবনের সব ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিলাম। সঙ্গে মনে পড়ছিল মায়ের মুখ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে উঠছিল অস্পষ্ট। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একটাবার যদি মায়ের কাছে বিদায় নিতে পারতাম। চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই।
রাজধানীর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিল্লাদ হোসেন যখন ফিরে আসার গল্প বলছিলেন, তখনো কাঁপছিলেন ভয়ে। ফ্যাকাশে মুখে বলছিলেন, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে যে বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই, সে সত্যটা সেদিন বুঝেছি। আল্লাহর দরবারে নিজেকে সপে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম মৃত্যুর। দুজন জলজ্যান্ত মানুষ, পাশ থেকে নাই হয়ে গেলো এক পলকে। আমি ফিরতে পারবো, ওই সময়ে ভাবনাতেও ছিলো না। তবে বেঁচে ফিরেছি। ফের বাবা-মা, স্বজন, দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে পেরেছি, এটা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ নেয়ামত। অযুত মানুষের জীবন, আর রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারমুক্ত যে দেশ পেয়েছি, সেটি লক্ষ বছর টিকে থাকুক। শকুনের দৃষ্টি থেকে হেফাজতে থাকুক।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে গত ১৯ জুলাই বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ঐক্য সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি দেয় বিএনপি। দুপুর থেকেই সেখানে জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা। দুপুর দুইটার দিকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের নেতৃত্বে পল্টন টাওয়ার থেকে মিছিলের প্রস্তুতি নেন দুই শতাধিক নেতাকর্মী। বিজয়নগর পানির ট্যাংকির পাশের প্রধান সড়কে ছিল পুলিশের অবস্থান। ছাত্রদল মিছিল শুরু করলে রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন আশপাশের অলিগলিতে। আধাঘণ্টার মধ্যে একত্রিত হয়ে আবার মিছিল নিয়ে প্রধান সড়কের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় চায়না রাইফেল দিয়ে সরাসরি অন্তত ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদল নেতা নবীন তালুকদারসহ দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এছাড়াও তিন নেতা গুলিবিদ্ধ হন। তারা হলেন, ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিল্লাদ হোসেন, সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ইমরান, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফখরুল ইসলাম ফাহাদ। তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান নেতাকর্মীরা।
মোটরসাইকেলে করে কাকরাইলের ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয় মিল্লাদ হোসেনকে। তবে চিকিৎসা দিতে অপারগতা জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে কাকরাইল মোড়ে বাধা দেয় পুলিশ। অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে শান্তিনগরের অরোরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। আইসিইউতে রেখে সেদিন রাতেই করা হয় অস্ত্রেপচার। কিন্তু একদিন পর ২১ জুলাই তাদের ১০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতাল ত্যাগ করার অনুরোধ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তারা জানায়, আন্দোলনকারীদের ধরতে ডিবি পুলিশ অভিযান চালাবে। এরপর সেখান থেকে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যান মিল্লাদ। পরদিন ফের ধানমন্ডি জেনারেল এন্ড কিডনি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই ২৬ জুলাই আরেকবার অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে, নিরাপত্তা সংকটের কারণে ৩০ জুলাই বাসায় চলে যান।
মিল্লাদ হোসেন হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার চারগাও গ্রামের জিতু মিয়ার ছেলে। তার বাবা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোদমে রাজনীতি শুরু করেন। ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
তিনি জানান, ছাত্র আন্দোলনের প্রথম থেকেই ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিলো। সাধারণ ছাত্রদের পাশে থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত সায়েন্সল্যাব মোড়ের কর্মসূচিতে অংশ নেই। ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় দুর্বিষহ দিন পার করেছি। সেদিন প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ভয়ে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতাল কোনো চিকিৎসা দেয়নি। শান্তিনগরের হাসপাতালে দুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর পুলিশি অভিযানের শংকায় সেখানেও থাকতে পারিনি। গুলিবিদ্ধ জায়গায় হাড়ের পরিবর্তে স্টিলের পাত বসানো হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চিকিৎসার ব্যয় বহন করার পাশপাশি সবসময় খোঁজখবর নিয়েছেন। এখনও চিকিৎসা চলছে।
ডাক্তাররা জানিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হাতটি কখনও স্বাভাবিক হবে না। তারপরও আরো একবছর তাদের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। পরে আবার অপারেশন করে স্টিলের পাত বের করতে হবে।
তিনি আরও জানান, শত কষ্টের মধ্যেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছি। আওয়ামী লীগ আমলে আমি ১২টি মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে একাধিকবার জেল খেটেছি। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছি। ডিবি কর্তৃক গুমের শিকার হয়েছি। দেশ স্বাধীন করতে যারা রক্ত দিয়েছেন আমিও তাদের একজন ভেবে কিছুটা শান্তি পাই, নিজেকে সান্ত্বনা দেই।