হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানি প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। পশ্চিমা আধিপত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো রাইসির মৃত্যু দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত- তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্তের পেছনে ওই দেশের ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজছেন কেউ কেউ। কারণ, এর আগেও মার্কিন হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ গেছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের।
ইরানের শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় সরগরম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও নেট দুনিয়া। বিশ্লেষকরা কষছেন নানা হিসাবনিকাশ। গণমাধ্যমগুলোতে বৈরী আবহাওয়ার জেরে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে রাইসির মৃত্যুর খবর প্রকাশ পেলেও, এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড- তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
নেটিজেনদের অনেকেই এ ঘটনার পেছনে আঙুল তুলছেন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। ইব্রাহিম রাইসি যে হেলিকপ্টারে ছিলেন সেটি ছিল মার্কিন হেলিকপ্টার বেল টু ওয়ান টু মডেলের। যুক্তরাষ্ট্রের বেল টেক্সট্রন মহাকাশযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রথম এটি তৈরি করে। ১৯৬৮ সালে কানাডিয়ান বাহিনী প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই হেলিকপ্টার কেনে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, হেলিকপ্টারটি ছিল মাঝারি আকারের। এতে পাইলটসহ ১৫ জন বসতে পারেন। তবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের কাছে এমন কোনও হেলিকপ্টার যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করেনি- এমন তথ্যও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, এর আগেও বেল টু ওয়ান টু মডেলের হেলিকপ্টার বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত উপকূলে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এই হেলিকপ্টার। এরও আগে, ২০১৮ সালে খোদ ইরানেই একই ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অন্তত চারজন। মার্কিন এই হেলিকপ্টারের দুর্বলতা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধমে উঠেছে প্রশ্ন। তেহরান কি হেলিকপ্টারের এই দুর্বলতা সম্পর্কে কিছু্ই জানতো না? এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ইরান। পররাষ্ট্রনীতি, অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন তৈরিসহ অগ্রগতিমূলক নানা পদক্ষেপের কারণে শক্তিশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রাইসি। পশ্চিমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিলেন এই নেতা। যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলোর জন্য রীতিমত হুমকি হয়ে ওঠেন তিনি। সম্প্রতি ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসির নেতৃত্বেই ইসরাইলি ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় স্বভাবিকভাবেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চক্ষুশুল হয়ে উঠেন ইব্রাহিম রাইসি। তাই হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের এই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা- এমনটি মনে করছেন না অনেকে।
হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পর কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। অনেকে বলছেন, ওই হেলিকপ্টারে প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনির প্রতিনিধি ছিলেন। দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকায় অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তাবলয় কম হওয়ায় টার্গেট করা সহজ ছিল শত্রুপক্ষের। এছাড়া, ইরানের সরকার বা দায়িত্বশীল সূত্র ছাড়াই আগেভাগে রাইসির নিহতের খবর প্রকাশ করে ইসরাইলি সংবাদ মাধ্যম। রাইসির পরবর্তী উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে সবার আগে নিউজ ও মন্তব্য প্রতিবেদন করে তারা। এছাড়া, হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হওয়ায় সেটার ডিজাইন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ত্রুটির বিস্তারিত জানা সহজ ছিল শত্রুপক্ষের।
এদিকে, ইব্রাহীম রাইসির মৃত্যুতে সামনে এসেছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হকের রহস্যজনক সেই মৃত্যুর ঘটনাও। ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি একটি হেলিকপ্টারের মহড়া দেখতে গিয়েছিলেন বাওয়ালপুরে। ফেরার পথে বিধ্বস্ত হয় লকহিড মার্টিনের তৈরি সি ওয়ান হান্ড্রেড থার্টি বিমানটি। উড্ডয়নের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মাটিতে আছড়ে পড়ে। এতে, জেনারেল জিয়াউল হকের পাশাপাশি নিহত হন পাকিস্তানের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল। এ ঘটনার পেছনে ওয়াশিংটনের হাত ছিল বলে পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পায়। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্র নিজ রাষ্ট্রদূতের বিনিময়ে জিয়াউল হককে হত্যা করেছে- এমন ভয়ংকর কথাও প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, নিজ রাষ্ট্রদূতকে হারিয়েও সে সময় নীবর ছিল যুক্তরাষ্ট্র! রাইসির মৃত্যুতে এসব অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
ইব্রাহীম রাইসি ছিলেন কট্টরপন্থী নেতা। হিজাব ইস্যুতে তরুণী মাশা আমিনীর মৃত্যুর জেরে তরুণদের পাশাপাশি অনেকের কাছেই অপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাইসি। তার মৃত্যুর পেছনে এ সবেরও যোগসাজশ খুঁজছেন অনেকে।