বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের একটি রায়ের পর সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভ নতুন করে ডালপালা মেলেছে।
বুধবার সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছে দেশটির হাইকোর্ট।
এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে কোটা পুনর্বহাল ইস্যুকে কেন্দ্র করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে।
কোটা আন্দোলনের একজন সংগঠক রাশেদ খান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তারা ভেবেছিলেন কোটা ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই একটি “মীমাংসিত” বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, আদালতের রায়ে তাদের সেই ভুল ভেঙেছে।
তবে কোটা বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বিভিন্ন সংগঠন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাংগঠনিক সম্পাদক রহিমুল ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’এটা আমাদের প্রাপ্য অধিকার বলে মনে করি। সেদিক থেকে এই রায় আমাদের জন্য একটি বিশাল অর্জন, আমাদের অধিকার রক্ষা করা হয়েছে। এমনকি ৩০ শতাংশের বদলে ২০ শতাংশ হলেও কোটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। হাইকোর্টের রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন হোক, এটাই প্রত্যাশা করি।‘’
তবে, কোটা ব্যবস্থার পক্ষে ও বিপক্ষে নানারকম মন্তব্য করেছেন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ।
কোটা ব্যবস্থা নিয়ে এই বিতর্কের পেছনে এটির প্রচলন এবং বাতিলের প্রক্রিয়ার মধ্যেই গলদ দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
“আবেগতাড়িত, সুবিবেচনাপ্রসূত নয়”
২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে, ওইবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটা বিরোধী আন্দোলন হয়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।
তার আগে এসব পদে চালু থাকা কোটার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
এর বাইরে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ আসন থাকতো।
কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই কোটার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যারা কথা বলে আসছিলেন তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় লেখালেখিও করেছেন তিনি।
কোটার হার বাড়ানো এবং বাতিলের সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াকেই এ সংক্রান্ত বিতর্কের জন্য দায়ী মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “প্রথম যখন সরকারি চাকরিতে কোটা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়িয়ে, ৫৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটি ছিল আতবেগতাড়িত এবং একতরফা সিদ্ধান্ত”।
বাতিলের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখেন এই অধ্যাপক।
“সংস্কার না করে পুরোটা বাতিল, জেদের বশে, আবেগের বশে করা হয়েছে। সেটিও সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি।”
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদেরও অবশ্য ব্যবস্থাটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি তুলতে দেখা যায়নি।
‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’এর ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলে সেগুলোর অন্যতম ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার।
আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন, ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ সেটিকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক।
তাদের সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল।
তবে, ২০১৮ সালে বাতিলের পর কোটা ব্যবস্থা বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের কয়েকটি সংগঠন।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তারা।
আগেই সতর্ক করেছিলেন সাবেক আমলারা
বাংলাদেশের একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলেছিলেন সেই সময়।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন লেখায় সেটিও উল্লেখও করেছেন অনেকবার।
তিনি বলেন, “কী করলে ভালো হতো, তা তো আর এখন বলে লাভ নেই। এখন সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে আপিল করা।”
পুরোপুরি বাতিল না করে সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন আরেকজন প্রাক্তন আমলা আকবর আলি খান।
কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেয়া উচিত নাকি এটাকে কমিয়ে আনা উচিত? এমন প্রশ্নে প্রয়াত আকবর আলি খান তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ” বাংলাদেশ সরকার তিনটি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস কমিশন স্থাপন করেছিল। তিনটি কমিশনই সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে কোটা একেবারে তুলে দেয়া উচিত।”
তবে হঠাৎ করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দিলে এটা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন তিনি।
সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করার পর দেখা যায়, আলাদা, আলাদাভাবে নারী অধিকার ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচিতে নামে।
মি: খানের ভাষ্য ছিল, নারী এবং উপজাতি কোটা পুরোপুরি তুলে দেয়া ঠিক হবে না। তবে কোটা ব্যবস্থা প্রতি পাঁচ বছর পর মূল্যায়ন করা উচিত বলেও মি: খান পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তবে এসব পরামর্শ আমলে না নিয়ে ২০১৮ সালের চৌঠা অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা চায় না। তারা আন্দোলন করেছে। ফলে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এনিয়ে আর আলোচনা করার বা হা-হুতাশ করার কিছু নেই ।”
”আমি বলে দিয়েছি থাকবে না। সেই থাকবে না’কে কিভাবে কার্যকর করা যায়, সেজন্য ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে দিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে, যাতে এটা বাস্তবায়ন করা যায়,” তিনি বলেছিলেন।
তবে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন।
সে রিটের শুনানি নিয়ে কেন ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
সর্বশেষ বুধবার সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
কোটাবিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের রায় আসার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ জানিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে।
বৃহস্পতিবার রাজু ভাস্কর্যের সামনে কিছু শিক্ষার্থীকে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে যেখানে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকা কিছু মুখও।
এছাড়াও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা।
তারা কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল করে হাইকোর্টের রায়কে প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেন।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, “আপিল বিভাগের মাধ্যমে রায় স্থগিত করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি আহ্বান” জানান তারা।