ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আইনি প্রক্রিয়াসহ প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে তিনি যে কোনো সময় লন্ডন থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হবেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় সন্তান।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর থেকেই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রত্যাবর্তনের ইতিবাচক খবরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বেশ উচ্ছ্বসিত। কবে নাগাদ তারেক রহমান দেশে ফিরবেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, যে কোনো সময় দেশে ফিরবেন তিনি এবং সেটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। ২০০৮ সালে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর বিএনপির তরফে বরাবরই বলা হয়েছে, তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। ২০১২ সালে তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে সেটি এক বছরের মধ্যেই গৃহীত হয় বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়। ফলে এ-সংক্রান্ত কিছু আইনি বিষয় শেষ হলেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। আজ বুধবার ঢাকায় এক সমাবেশে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়াল মাধ্যমে বক্তব্য দেবেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমানকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিদেশে নির্বাসিত করা হয়েছে। তিনি এ আন্দোলনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন, তাকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। উনি যখনই মনে করবেন হি ক্যান কাম ব্যাক… আমরা আমাদের অনুরোধ জানিয়েছি যে, দ্রুত চলে আসেন। সেই ব্যবস্থা হবে।’
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে তাকে অনেক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এর আগেও তারেক রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রী-এমপিরা এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, “তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মূল রাগের কারণটা হলো, তিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান করেছেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডানপন্থি, বামপন্থি, সমাজতন্ত্রী, ইসলামী দল সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকারের বিরুদ্ধে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন যে, এর ফলে ১০ ভাগ লোকও ভোট দিতে যায়নি। তার নেতৃত্বে একদফার আন্দোলন সফল হয়েছে। এখন তিনি ‘বীরের বেশে’ দেশে ফিরবেন।”
২০০১ সালে বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারেক রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় হন। দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নিয়মতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অপসারণ করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ওই সরকার দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ একটি দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তার বিরুদ্ধে আরও ১৩টি দুর্নীতির মামলা করা হয় ও তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিএনপির দাবি। শুধু তা-ই নয়, বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার আড়ালে তাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলেও দলটির দাবি।
গ্রেপ্তারের কিছুদিন পর তারেক রহমানকে আদালতে হাজির করা হলে তার ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেন তার আইনজীবীরা। আদালতের নির্দেশে চিকিৎসকদের একটি দল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আদালতকে জানায় যে, তারেক রহমানের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ যুক্তিযুক্ত। একপর্যায়ে আদালত রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ শিথিল করেন এবং তারেক রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়। ২০০৭ সালে ২৫ আগস্ট তারেক রহমান হাসপাতালে পা পিছলে পড়ে আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
একপর্যায়ে ২০০৮ সালের আগস্টে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো আদালতে গতি পায়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সব মামলায় তারেক রহমানের জামিন হয় ও বিএসএমএমইউ থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি লাভ করেন। এরপর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। তখন থেকেই সপরিবারে লন্ডনে আছেন তারেক রহমান।
এর মধ্যে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে ওইদিনই কারাবন্দি হন। এরপর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান।
২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়।’
ওয়ান ইলেভেনের সময় এবং পরে আওয়ামী লীগ আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা অসংখ্য মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত চারটিতে তার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ২০১৩ সালে বিচারিক আদালতের রায়ে তিনি খালাস পেলেও পরে উচ্চ আদালত তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারও সাজা হয়। তারেককে দেওয়া হয় ১০ বছরের কারাদণ্ড। একই বছরের অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তারেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের আরেকটি ধারায় তার ২০ বছর কারাদণ্ডাদেশ হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২ আগস্ট জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তারেক রহমানকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই মামলায় তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আজ ঢাকায় সমাবেশে প্রধান অতিথি
এদিকে শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি আজ বুধবার ঢাকায় প্রথম সমাবেশ করবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দুপুর ২টায় রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির উদ্যোগে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন গতকাল এক বার্তায় এই তথ্য জানিয়ে বলেন, সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় নেতারাও বক্তব্য দেবেন। সর্বস্তরের জনগণসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে যথাসময়ে সমাবেশে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি।