সন্তানের স্কুল থেকে বাজার, সরকারি গাড়ি অবাধে ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিগত কাজে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে সরকারের কতগুলো গাড়ি আছে তার সঠিক সংখ্যাও জানে না অধিদফতর। পরিবহন পুল বলছে, মোট সরকারি গাড়ির মাত্র ১০ ভাগ সরবরাহ করেন তারা। বাকি ৯০ শতাংশই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের। তবে উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলেও নিয়ম মেনে গাড়ি জমা হয় না পরিবহন পুলে।
রাজধানীর বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় এলাকা। নো পার্কিং জোনে সকাল থেকে স্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাধিক সরকারি গাড়ির এসি চালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেমন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে একটি গাড়ির চালকের সাথে কথা বলে জানা গেল, সেটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের গাড়ি। সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে দিতে ওই গাড়ি নিয়ে তার ম্যাডাম নিয়ে এসেছেন।
পাশেই শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি পাজারো গাড়ি দেখতে পেয়ে সেখানে সময় সংবাদ। কথা বলে জানা গেল, সাইদুর রহমান নামের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওই গাড়ি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে এই গাড়ি নিয়ে এসেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিয়েই আবার ওইসব গাড়ি ও তার চালকরা ছুটি পান না। একটি অংশ সেখানেই অপেক্ষা করেন ছুটি হওয়া পর্যন্ত। আর মাঝের এই অংশে চলে এসি, পুড়ে জ্বালানি।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং মলের মতো একইচিত্র কারওয়ান বাজারেও। ৩ জুলাই বুধবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যেসব সরকারি অফিস কারওয়ান বাজারে নয়, সেসব অফিসের সরকারি গাড়িও বাজার করতে হাজির হয়েছে এখানে।
৩ জুলাই কারওয়ান বাজারে বাজার করতে আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই গাড়িটির দেখা পাওয়া যায়। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া
এরমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৭৯৭৫ নম্বরের একটি লাল রংয়ের পাজারোর চালকের সাথে কথা বলে জানা গেল, ওই কর্মকর্তা নিজেই অফিস ফেলে বাজার করতে চলে এসেছেন।
এভাবেই সরকারি গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে পারিবারিক কাজে। সন্তানদের স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ঘুরতে যাওয়া সবই হচ্ছে সরকারের জ্বালানি খরচ করে।
সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও সারা দেশে সরকারি অফিসে যানবাহন সরবরাহের কাজটি করে সরকারি যানবাহন অধিদফতর। সরেজমিনে দেখা যায়, এই ভবনের তিনতলা পর্যন্ত পুরোটাই অচল গাড়ির আস্তানা।
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন না করলে তথ্য দেবে না এই অধিদফতর। আবেদনের পর জানা গেল, এখান থেকে সারা দেশে সরবরাহ করা যানের সংখ্যা মাত্র আড়াই হাজার। এরমধ্যে অচল গাড়ির সংখ্যা ৬৩ এবং বাকিগুলো সচল। এখন প্রশ্ন হলো সরকারি কর্মকর্তারা তবে এতো গাড়ি পাচ্ছেন কোথায়, যা দিয়ে ব্যক্তিগত কাজে পরিবারের চাহিদাও মেটাচ্ছে?
নথি বলছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর ও বিভাগ নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী সরকারের টাকায় গাড়ি কেনে। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের শুরুতেই কেনা হয় নতুন নতুন গাড়ি। নিয়ম হলো, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরই এসব গাড়ি জমা হবে পরিবহনপুলে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও গাড়ি জমা হয় না।
গত পাঁচ বছরে পরিবহনপুলে উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি জমা হয়েছে মাত্র ১৫০টি। যদিও গত পাঁচ বছরে শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৫০টি মন্ত্রণালয়ে কত হাজার গাড়ি কেনা হয়েছে; সেটি জানে না পরিবহনপুল।
সরকারি যানবাহন অধিদফতরের পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাড়িগুলো যদি নিজ থেকে জমা দেয় তারা তাহলেই আমরা নিতে পারি। এর বাইরে আমাদের হাতে এমন কোনো মেকানিজম নেই যেটা দিয়ে আমরা তাদের বাধ্য করতে পারব প্রকল্প শেষে গাড়ি জামা দিতে। অর্থাৎ, এমন কোনো আইন নেই। যার কারণে আমাদের কিছু করার থাকে না।’
সাবেক আমলারা বলছেন, অচল গাড়িগুলো নিলামে বিক্রি বা সরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে দিয়ে দেয়া উচিত। তাতে সরকারের যেমন রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ থাকে, তেমনি গাড়িগুলোও কাজে লাগতে পারে। পাশাপাশি সকল মন্ত্রণালয়ের সব ধরণের গাড়ি হিসেবের দায়িত্ব পরিবহনপুলের ওপর ন্যস্ত করা গেলে অচল হিসেবে দিনের পর দিন কোটি টাকার গাড়িগুলো নষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
এমন অবস্থায় সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, কম খরচে পরিবহন করতে পারলে মানুষের উপকার হয়। আমরা কক্সবাজার বা পাহাড়ি এলাকায় চাঁদের গাড়ি দেখি। ওগুলো অনেক পুরনো, সেই গাড়ি এখনও ভালোভাবে চলতে পারলে পড়ে থাকা এই গাড়িগুলো কেন ব্যবহার হবে না?
এরইমধ্যে গত মঙ্গলবার (২ জুলাই) জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তৃতীয় বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্প শেষে যেসব প্রকল্প থেকে সরকারি যানবাহন অধিদফতরে গাড়ি ফেরত দেয়া হয়নি তাদের পত্র দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব গাড়ি দ্রুত ফেরত দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।