27 C
Dhaka
Tuesday, July 2, 2024

মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে ২ হাজার টাকা খরচ করলেই কমে ভোগান্তি

মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই অনেক মানুষ আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যে কেউ আসেন নতুন পাসপোর্টের আবেদন করতে, কেউ আবেদন জমা দিতে, আবার কেউবা আসেন নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে। তবে সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্টের আবেদন করলে নানা ছুতোয় আবেদনে ভুল রয়েছে বলে ভোগান্তিতে ফেলছে অফিসের দায়িত্বরত স্টাফরা। কিন্তু দালালের শরণাপন্ন হয়ে আবেদন করলে সব কাজ দ্রুত হয়ে যায়। আর এ জন্য সেবাগ্রহীতাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত এক থেকে দুই হাজার টাকা।

সম্প্রতি সরেজমিনে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দেখা গেছে, অফিসের নিচতলায় আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কাউন্টারে সেবাগ্রহীতাদের দীর্ঘলাইন। আর ডেলিভারি কাউন্টার থেকে দেওয়া হচ্ছে পাসপোর্ট। এ ছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলার জন্য ১০৬নং কক্ষের বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন অনেক সেবাগ্রহীতা।

এদিকে অফিসের সামনের সড়কের পাশে ৩০ থেকে ৩৫টির মতো ছোট ছোট কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকানের ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় দালালরা সেবাগ্রহীতাদের পাসপোর্টের ফরম পূরণ করে দিচ্ছেন। আবার অনেক দোকানদারাই দালালের হয়ে কাজ করছেন। দালালরাই পাসপোর্টের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়াসহ পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজও করে দিচ্ছেন। দালালদের চিহ্নিত করা সেবাগ্রহীতাদের অফিসের দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা পাসপোর্টের আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করার জন্য বা স্বাক্ষরের জন্য সরাসরি সহকারী পরিচালকের কক্ষে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফলে দালালচক্রের শরণাপন্ন সেবাগ্রহীতাদের কোনো প্রকার ভোগান্তি বা হয়রানি ছাড়াই পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সেবাগ্রহীতাদের অধিকাংশই নিজের আবদেনপত্র জমা দিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। আবার আবেদনপত্রে কোনোপ্রকার ভুল হলে তো কথাই নেই। এদিকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিসে গিয়ে সহকারী পরিচালককে পাওয়া যায়নি। তবে তাকে দুপুর সাড়ে ১২টার পর একটি মোটরসাইকেলে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়।

আরো পড়ুন  মেয়েকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা, নেপথ্যে কি?

জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিস থেকে সাধারণ ও জরুরি এই দুই ধরনের পাসপোর্টে করা যায়। ৪৮ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের (১৫ কর্মদিবস) জন্য সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ২৫ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের (৭ কর্মদিবস) জন্য ৬ হাজার ৩৯৫ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের (২ কর্মদিবস) জন্য ৮ হাজার ৬২৫ টাকা নেওয়া হয়। আর ১০ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য ১০ হাজার ৩৫০ টাকা লাগে। অন্যদিকে ৬৪ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, জরুরি ৮ হাজার ৬২৫ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য লাগে ১২ হাজার ৭৫ টাকা। আর ১০ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য লাগে ৮ হাজার ৫০ টাকা, জরুরি ১০ হাজার ৩৫০ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য ১৩ হাজার ৮০০ টাকা সরকারি হিসাবে লাগে।

জেলার সিংগাইর উপজেলার কালিয়াকৈর এলাকার ইমরান হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক দূর থেকে আসছি পাসপোর্ট করতে। নিজেরা করতে গেলে অনেক সময় হয়রানিসহ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এত ঝামেলা করার সময় নাই, তাই হয়রানি এড়াতে দালালের শরণাপন্ন হয়েছি। নির্ধারিত ফির চেয়ে দেড় হাজার টাকা বেশি দিয়ে এক দালালের সঙ্গে চুক্তি করেছি। অ্যাইজকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ছবি তুইলাই যামু, আর একদিন আইসা পাসপোর্ট নিয়া যামু। ঝামেলা ভালো লাগে না, তাই বাধ্য হয়েই দালাল ধরেছি।’

একই উপজেলার জামির্তা গ্রামের মাসুদ মিয়া বলেন, ‘অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার আগের কয়েকজনকে দেখলাম আবদেনপত্রে কি যেন ভুল হইছে এইজন্য তারা জমা দিতে পারে নাই। পরে হয়রানি এড়াতে আমি দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা দিয়েছি।’

আরো পড়ুন  সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে পুলিশ সদস্য, অতঃপর...

সাটুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা সাহিনুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিজে পাসপোর্ট করতে গেলে অফিসের স্টাফরা আবেদনপত্রে এই ভুল, সেই ভুল দেখিয়ে হয়রানি করে। এজন্য দালাল ধরেছি। হয়রানিসহ ভোগান্তি এড়াতে দালালকে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়েছি। দালাল না ধরলে পাসপোর্ট পাইতে মেলা ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

তবে দালালের নাম জানতে চাইলে তিনি অসম্মিত প্রকাশ করেন।

সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে চাকরি শেষে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি এলপিআরে যান হারেজ আলী (৪৮)। পাসপোর্ট অফিসে তার সঙ্গে আলাপ হলে বলেন, ওমরা করার জন্য নতুন করে পাসপোর্ট করতে এসেছি। আগের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। আবেদনে মায়ের নামের ইংরেজি অক্ষরে ভুল হয়েছে। এজন্য সংশোধন করার জন্য বসে আছি। অফিসের সহকারী পরিচালকের স্বাক্ষর হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তুলতে পারব। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, আগের চেয়ে মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের কাজের মান ভালো হয়েছে।

সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে রফিক নামের এক দালালের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগের পাসপোর্টের সঙ্গে আপনার ভোটার আইডি কার্ড আর চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট না থাকলে বাসার বিদ্যুৎ বিলের একটা কপি নিয়া আসবেন। আর কিছুই লাগবো না, সাড়ে ৮ হাজার টাকা দেবেন কালকেই আবেদন, ব্যাংকে টাকা জমাসহ ফিঙ্গার আর ছবি তুইলা যাবেন। ১৮ থেকে ২০ দিন পর আইসা পাসপোর্ট নিয়া যাবেন। আর পুলিশের বিষয়টা আমিই দেখব, আপনার কোনো প্যারা নিতে হবে না।’

এক সেবাগ্রহীতার কাছে জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার এক স্বজনের পাসপোর্ট করতে এসেছি। এই অফিসের একজনকে ধরে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। এখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ছবি তোলার জন্য অপেক্ষায় আছি।’

আরো পড়ুন  জানা গেল সেই তিন জনপ্রতিনিধির এসএসসির ফল

তিনি এই প্রতিবেদককে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আপনার ছোট ভাই আর ভাতিজার পাসপোর্টের আবেদনপত্র দ্রুত জমা এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তুলতে চাইলে এই অফিসের পাসপোর্ট ডেলিভারি কক্ষে যিনি আছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুটি পাসপোর্ট আবেদনের জন্য দুই হাজার টাকা বাড়তি দিলেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই জমা দেওয়াসহ ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ছবি তোলাসহ দ্রুত পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন।’

তবে অফিস স্টাফদের সঙ্গে দালালচক্র বা অন্য কারোই কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক নেই দাবি করে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক অরূপ রতন চাকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দালালচক্রের সঙ্গে অফিসের স্টাফদের কোনো যোগসাজশ নেই। যারা এই ধরনের কথা বলেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সরকারি এই ধরনের অফিসের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য সব সময় একটি চক্র কাজ করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, গড়ে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০টি আবেদন জমা পড়ছে। এ ছাড়া ২০ থেকে ৩০টির মতো পুরোনো পাসপোর্ট জমা দিয়ে নতুন করে নবায়নের আবেদনপত্র জমা পড়ছে। আর প্রতিদিন গড়ে ১২০টির বেশি পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের কাছে ডেলিভারি দেওয়া হয়।

সেবাগ্রহীতারা সরাসরি আবেদন জমা দিতে গেলে অফিসের দায়িত্বরত স্টাফরা নানা ছুতোয় ভুল ধরে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি বা ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফিস স্টাফরা কোনো সেবাগ্রহীতাকে হয়রানি বা ভোগান্তিতে ফেলার বিষয়টি সঠিক নয়। সেবাগ্রহীতাদের সেবা দিতেই তারা কাজ করছেন। এ বিষয়ে আমি নিজেই সার্বক্ষণিক তদারকি করি।

সেবাগ্রহীতাদের আবেদনপত্র সঠিক থাকলে কেউ সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন না বলেও তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ সংবাদ